Monday, June 26, 2006

তীর্থ,ত্রিমাত্রিক


আমি যেতে চাইনি।
আমি যেতে চেয়েছি।
আমি গিয়েছি......
পরিনতিটাই তো চুড়ান্ত সত্য । যা ঘটল শেষ পর্যন্ত।
'হতে পারতো' 'হওয়ার কথা ছিল' এসব তো ব্যবহৃত টিস্যু পেপারের মতো ফাঁপা নিঃশ্বাস।
কতো কথা,কতো কথা দেয়া।আরো কতো কথা নেয়া।

তারপর...?
জীবন দাস কবি । থাকে শুধু অন্ধকার।
যে বৃক্ষের নীচে পাঁজর বদলে নিতাম পরস্পর,তার ডালপালা এখন ক্রমশ মৃয়মান। মাঝে মাঝে নিজেকে শকুনের মতো মনে হয় । একে একে সবাই পাড়ি জমাচ্ছে পাউন্ড ডলারের বেহেশতে।আমি একা এক হরিদাস পাল আটকে আছি এই মৃত ভাগাড়ে।

সেদিন চামেলীকে দেখলাম।মেয়ে নেই আর।মাশাল্লাহ মহিলা হয়ে গেছে গায়ে গতরে।সোনাদানা গায়ে লেপ্টে রিক্সার ঘোমটা তুলে যাচ্ছে কোথাও ।পাশে এক মাঝ বয়সী মধ্য শ্রেনীর লোক।ওর স্বামী নিশ্চয়।চামেলীর বিয়েতে আমরা গিয়েছিলাম।কিন্তু লোকটার চেহারা মনে নেই। আচ্ছা বিয়ের পরে লোকজন বউ নিয়ে ঘোরতে বেড়োলে রিক্সার ঘোমটা তুলে কেনো? বিবাহিত জীবনের অশ্লীলতা গুলো আরো আড়াল করার জন্য?
এই চামেলীকে তুমি ভয়াবহ সতর্ক করে দিয়েছিলে যেনো আমার কাছ না ঘেঁষে।এই নিয়ে ক্লাশে কতো হাংগামা!
আর সেই প্রথম জানলাম চামেলী আমার কাছ ঘেঁষতে চেয়েছিল,সেই প্রথম জানলাম তুমি আমাকে ভালোবাসো?
সেই তুমি এখন?----ব্যবহৃত টিস্যু পেপারের মতো ফাঁপা নিঃশ্বাস।

আর আমি তখন ভূগছি গোপন অসুখে।বোধের এবং মননের।
ক্লাশের শেষ ডেস্কে বসে টু ফাইভ সিগ্রেটের ফাঁপা শরীরে ঢুকাই মোহিনী গুঁড়ো।টান দিয়ে বন্ধুরা দেখে ড্রেস করা মাংসের পেকেট আর আমি ধরি বাতাস থেকে মোহময় শব্দ গুচ্ছ। শব্দ দিয়ে বাক্য গাঁথিঃ
'নোংগর তুলে নিলে নরোম মাটির বুকে থেকে যায় দাগ
মাটি না নোংগর,কার বুকে জন্মায় এতো অনুরাগ?'
আমি আমার বুকে এই দগদগে দাগ টের পেলাম,যাদিন নোংগর উঠে গেল বুক থেকে তুমুল আনুষ্ঠানিক্তায়।
এর আগে টের পাইনি আমি।
একদিন ও না!

কেননা এর আগেই ভেংগে পড়েছে বার্লিনের দেয়াল,মহামতি লেনিনের তর্জনী ভূপাতিত,সমাজতন্ত্রীদের যৌনক্রিয়ায় ব্যাপক তৃপ্তি দিচ্ছে ইউনাইটেড স্টেট অফ ভয়ংকর আমেরিকার কার্যকর ভায়েগ্রা।
আর তারো আগে প্রথম কৈশোরেই কি করে যেন আমার জানা হয়ে গিয়েছিল--সাম্যবাদ আর পুঁজিবাদের মধ্যে যুদ্ধ যদি বন্ধ হয়ে যায়, যদি ভালোবাসা আর ঘৃনার ভিন্ন মানে না থাকে--তাহলে মানুষ আর বসত গড়বেনা মানুষের বুকে।তখন পুরুষেরা জীবিকার নামে দাস হবে পুজিঁর আর নারীরা বিবাহের নামে হবে যৌনদাসী।
আর মানুষ ইতিহাসের পরিনতি বলেই, লেনিন ভেংগে পড়লে এক হরিদাস পাল কবির প্রেমিকাকে বিয়ে করে নিয়ে যায় বিদেশী বনিক।
পরিনতি জানা তবু তার প্রতিক্রিয়া এত তীব্র হলো কেনো?

ভালোবাসার উষ্ণ দিন গুলোতে যে তুমি আসোনি আমার শব্দে কিংবা বাক্যে,বিরহের শীতলতায় সে তোমার কেনো এত তীব্র উপস্থিতি? আর একি বিরহ? প্রত্যাবর্তনের সম্ভাবনাহীন প্রস্থান কি কোনো অর্থ বহন করে? এই অনর্থ যদি বিরাট অর্থবহ হয়ে দাঁড়ায়,তবে তার কোনো মানে হয়?

-----'জোছনার অন্ধকারে আমি এক অন্ধ তীরন্দাজ'
জোছনার অন্ধকার মানে কি? অন্ধ হলে তীরন্দাজ হ্য় কি করে?
এই সব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে খুঁজতে সুমনা যখন আমার খুব বুক ঘেষে আর আমারো রক্তে জাগছে শিকারের নেশা,তখন তুমি কেন প্রশ্নবোধক চিহ্ন হয়ে হ্যমারিং শুরু করেছিলে?কি মানে ছিলো আমার এই স্বপীড়নের,যখন তুমি ওম বিলাচ্ছো অন্য বিছানায়?
প্রতিটি পুরুষের কিছু নিজস্ব গোপন আনন্দ থাকে।মধ্যরাতের নির্ঘুম ফ্যান্টাসীতে সুমনা,তানিয়া অথবা রাস্তায় দেখা আটোসাঁটো জামার অচেনা মেয়েটা।
আমি প্রবল ভাবে চাই,তোমাকে চাই আমার নিরাভরন কল্পনায়। হৃদয়বান পুরুষের স্বর্গ তো ওখানেই। ওই স্বর্গে তোমার সাথে মিলিত হয়ে,তোমাকে ক্ষমা করে আমি বেঁচে উঠি।
সত্যি আমার তাই মনে হয়।
তুমি নেই অথচ তোমার উপস্থিতি আমাকে প্রবল ভোগায়।
আমার জরুরী হয়ে উঠে নিজের কাছে প্রমান করা যে তুমি তেমন বিশেষ কেউ নয়।
কিন্তু কি আশ্চর্য আমি আমার কল্পনায় ও বন্দী তোমার কাছে। যুক্তি ও বোধের এই প্রবল বৈপরীত্য আমাকে ক্রমশঃ অসহায়, বিরক্ত ও ক্রুদ্ধ করে তুলছিল।
তোমার কাছ থেকে মুক্তি পাওয়াটা খুব জরুরী হয়ে পড়েছিল।

আর তাই...
আমি গিয়েছিলাম।
তার কাছে।তাদের একজনের কাছে।হাজার বছর ধরে যারা পুরুষের নিরুপায় অশ্লীলতাকে বরন করেছে পুঁজির মূল্যে।
মেয়েটা খুব উষ্ণ ছিল।মেয়েটা খুব কৌশলী ছিল। সে আমার সবটুকু নিংড়ে নিয়েছিল। সে আমার প্রথম ছিল।
আর সে আমাকে মুক্তি দিয়েছিল অর্থহীন আবেগ আর নিস্ফল ভালোবাসা ফাঁদ থেকে।

এখন রোজ রাতে অন্য সবার মতো তুমি ও উষ্ণতা বিলাও আমার বিলাসী অশ্লীলতায়।
ভোক্তার কাছে সকল পন্য ই যেমন ভোগ্য, মুক্তবাজারে সকল দাস-দাসী ও তাই।
তুমি এবং আমি ।।

[ কবেকার লেখা? ২০০৩ হতে পারে...]

Saturday, June 24, 2006

গুল্ম ও কুঠার

[এসব ভাবনা তোমাকেই ভেবে, প্রিয় সতেরো সেপ্টেম্বর]

খেলাটা আমি প্রথম শিখেছিলাম হাসানের কাছে ।

সেদিন আমার বিশেষ কোনো কাজ ছিলনা । তেমন থাকেনা কখনোই । ভর দুপরে হাজির হয়েছিলাম ওর অফিসে ।
ও বেশ আগ্রহ নিয়ে আমাকে বলেছিল --'একটা জিনিস দেখবি ?'
---দ্যখা । আমার আসলে আগ্রহ ছিলনা তেমন ।
তবু ওর কথামতো চোখ রেখেছিলাম কম্পিউটার স্ক্রীনে । তেমন কিছুনা । কটা আবছায়া রেখা শুধু ।
---'রেখাগুলোর মাঝখানে চারটা বিন্দু দেখছিস? ওখানে চোখ রাখ । একেবারে ৩০ সেকেন্ড । একটু ও নড়বিনা ।
চোখের পলক ফেলবি না । '
আমি তাই করলাম ।
---'এবার চোখ বন্ধ কর । ঘাড়টা একটু পেছনে হেলিয়ে দে '
আমি ওর নির্দেশ শুনি ।

প্রথমে অন্ধকার । প্রিয় অন্ধকার । একটু ফিকে ক্রমশঃ ।
একটা গোলাপী বলয় ।
তার ভেতরে কিযেন একটা । কে যেন এক!
একটা চেহারা । আসছে... যাচ্ছে... ভাসছে । ধরতে পারছিনা, পারছিনা । হঠাৎ.. স্থির ।
যেশাস! যীশুর মুখচ্ছবি । মানুষের সমস্ত পাপ ধারন করে যে ক্রুশ কাঠে বিদ্ধ করেছিল নিজেকে ।

সেদিন পরপর তিনবার কম্পিউটারে খেলাটা খেলেছি আমি । হাসান কম্পিউটারের লোক । ও কিসব লজিক টজিক দিয়ে খেলাটার একটা ব্যখ্যা দিয়েছিল আমাকে । বোঝিনি । সবকিছুর সব ব্যাখ্যা ভাল্লাগেনা আমার

সেদিন পুরোটাই যেন ছিল আমার জন্য শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ।
হাসানের শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত অফিস থেকে বেরিয়ে ফুটপাতে দাঁড়াতেই প্রতীতি ও তার চার চাকার মোটর যান । ওটা ও শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত। শালার দেশটা কি আইসল্যান্ড হয়ে যাচ্ছে নাকি ? নাকি মানুষের চর্বি জমছে বেশী, তাই গরম ও বেশী বেশী!
গাড়ীতে উঠার পর প্রতীতি জানালো ও আমাকে সকাল বেলা থেকে খুঁজছে । আজ আমার জন্ম দিন ।
আহ্‌ হা ! এই মাত্র মনে পড়ল । Happy Birthday to me!
ঘুম থেকে উঠে মনে পড়লে তো নিজের গালে নিজেই একটা চুমো দেবার চেষ্টা করতাম । যায় নাকি ওরকম? নিজের গালে নিজে চুমো ? আমি কারো গালে এখনো চুমো দেইনি । আমাকে ও কেঊনা । বলবো নাকি প্রতীতিকে?
থাক্‌- বেচারা হাসান মাইন্ড করবে । নারী আর নদী কেবলি ভাংগে । গড়ে ও । কিন্তু সেতো ভাংগনের পর প্রলেপ মাত্র ।

সেই দুপুরে, আমার জন্মদিনের দুপুরে প্রতীতি আমাকে খাইয়েছিল একটা শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত রেঁস্তোরায় ।
প্রতীতি আমার প্রেমিকা না।প্রতীতি কবিতা বোঝেনা।প্রতীতি প্রীতিলতাকে চেনেনা।প্রতীতি হিন্দী সিরিয়ালের পোকা।প্রতীতি আমার মাথাব্যথা।

একবার আমি কাউকে কিছু না জানিয়ে হারিয়ে গিয়েছিলাম কয়েকদিনের জন্য। আসলে আমি চলে গিয়েছিলাম শহর ছাড়িয়ে বেশ দুরের এক চা-বাগানে। আমার এক বন্ধু ছিল ওখানে। সেই চা-বাগানের ভেতর খ্রীস্টানদের একটা কবরস্থান । রাবার গাছ ঘেরা । কি ভীষন নির্জনতা ছিল সেখানে। টুপটাপ অক্সিজেন ঝ্রে পড়ার শব্দ শুনেছিলাম আমি । রাবার গাছের বিচিগুলো অদ্ভুত সুন্দর । যেন আল্পনা আঁকা । কার কথা ভেবে যেনে কটা নিয়ে এসেছিলাম পকেটে করে ।
শহরে ঢুকতেই প্রতীতির সাথে দেখা । আমি আমার সবটুকু উজাড় করে দিয়েছিলাম । ও গ্রহন করেছিল । হেসেছিল । হয়তো হাসিতে ভালবাসাই ছিল । কিন্তু আমি কেন যেন তাচ্ছিল্য দেখেছিলাম।

ওর বড় বেশি ভালোবাসা । শরীরে, মনে, সবকিছুতে । বালিকা বাস করে বায়ুমাঝে । বালিকা জানেনা ঘৃনা করতে না জানলে সত্যি করে ভালবাসা যায়না । যেমন চাঁদ তারাকে ঘৃনা না করলে ভালোবাসা যায়না লালসবুজকে । মধ্যপ্রাচ্যের মানচিত্রে ঘৃনা,কানকুনের বনিক সভায় ঘৃনা,ধর্ম গ্রন্থগুলোর পাতায় পাতায় ঘৃনা । প্রতীতি ওসবের খোঁজ রাখেনা ।

রেস্তোঁরায় মুখোমুখি বসে আমার চোখ পড়েছিল ওর রাজ হংসীর মত গলায় । ওখানে একটা চমৎকার তিল । ইচ্ছে হয়েছিল ওখানে চোখ রেখে ওই খেলাটা শুরু করি আবার ।প্রতীতি চোখ নামিয়েছিল কিন্তু আমার আর মনঃসংযোগ হয়নি।

সেদিন বাড়ি ফিরি আমি মাঝরাতে ।
দেয়াল টপকে ভেতর বাড়ি । শেওলা ধরা সিঁড়ি বেয়ে আমার দেড়তলার খুপড়িঘরে। নীচে বড়ভাইয়ের ঘরে বাতি নেভানো।নিষিদ্ধ শব্দমালা, ভালোবাসা অথবা ঘৃনার পদাবলী। পাশের ঘরে বাবার কাশির শব্দ । জীবনের দায়শোধ । জননী সে দায় শোধ করে চলে গেছেন আমাকে জন্ম দিতে গিয়ে ।

বহুদিন পর সেই রাতে আমার মনে পড়েছিল- এক সময় আমি ছবি আঁকতাম । পাখী,মাছ,ফুল,প্রজাপতি,ঘোমটা দেয়া বৌ। সবল মাঝি,ভালোবাসা । বিছানার নিচে তখনো ক্ষয়ে যাওয়া রংতুলি, শুকিয়ে যাওয়া রংয়ের কৌটা ।
শুকিয়ে যাওয়া রংযের কৌটায় জল ঢেলে ক্ষয়ে যাওয়া তুলি ভিজিয়ে আবছায়া কটা টান দিয়েছিলাম কোনার দেয়ালে ।
না পাখী,না মাছ,না ফুল,না প্রজাপতি,না ঘোমটা দেয়া বউ,না সবল মাঝি,না ভালোবাসা ।
আমি কেবল কটা টান দিয়েছিলাম ঘৃনার । আর তার ভেতর কটা বিপরীত ফোঁটা ছিল । ভালোবাসার ।
তারপর শুরু করেছিলাম সেই খেলাটা ।

ঘৃনার দাগের ভেতর ভালবাসার কটা ফোঁটা । সেগুলোতে চোখ রাখা একটানা । তারপর চোখ বন্ধ করে ঘাড়টা একটু পেছনে হেলে দেয়া । একটা আবছায়া গোলাপি বলয় । কিন্তু এবার আর যিশু নয় । ওখানে এক বালিকার মুখ । সেই বালিকা ফ্রেম বন্দী হয়ে আছে আমার বাবার সাথে বিয়ের ছবিতে ।

সেই রাত থেকে প্রতিরাতে এই খেলাটা খেলি আমি । সেই একই খেলা । মাঝে মাঝে মুখগুলো বদলায় শুধু ।
কখনো সে মুখ মার্গারেট ম্যাতিউস,কখনো প্যালেস্টাইনের কোনো অচেনা কিশোরী- যে বুকে বোমা বাঁধছে প্রবল ঘৃনায় তার তীব্র ভালোবাসাকে বাঁচাবে বলে ।
আমি ওখানে একটা মুখ দেখতে চাই । সে কারনেই আমার প্রতিরাতের আয়োজন ।
জানি একদিন সে মুখ আমি দেখবো নিশ্চিত । আর সেদিনই শেষ হয়ে যাবে আমার এ খেলা ।
আমার আশ্চর্য উদ্ধার । ।

[২০০২ এর কোন একদিন লেখা ]