Wednesday, September 08, 2010

'বিটুইন দ্যা এসেসিনেশন'।। লেখালেখি'র কড়চা


অরবিন্দ আদিগা'র প্রথম উপন্যাস, ২০০৮এর বুকারজয়ী 'দ্যা হোয়াইট টাইগার' আমি পড়িনি। তার দ্বিতীয় উপন্যাস 'বিটুইন দ্যা এসেসিনেশন' প্রকাশিত হয় নভেম্বর ২০০৮ এ ,যদিও এটি আসলে দ্যা হোয়াইট টাইগারের আগেই লেখা।


এই উপন্যাসটি পড়েছি গতবছরের শেষের দিকে কিংবা এবছরের শুরুতে। উপন্যাসের সময় পরিক্রমা ১৯৮৪ থেকে ১৯৯১। ১৯৮৪ তে নিহত হন ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী, ১৯৯১ এ রাজীব গান্ধী। এই দুই হত্যাকান্ডের মধ্যবর্তী সময়ে ভারত রাষ্ট্রের নাগরিক জীবনের গল্পই এই উপন্যাসের প্রতিপাদ্য। অরবিন্দ আদিগা এই ফিকশনে ভারত রাষ্ট্রের রেপ্লিকা হিসেবে কিট্টুর নামে একটা জনপদের ছবি এঁকেছেন। কিট্টুর এর অবস্থান বলা হয়েছে আরব সাগরের তীরে, উত্তর-পশ্চিম উপকুলে। গোয়া ও কালিকটের মাঝামাঝি কোথাও। কিট্টুরে ধনী আছে, মধ্যবিত্ত আছে, দরিদ্র আছে। হিন্দু আছে, মুসলমান আছে, খ্রীষ্টান আছে। ব্রাম্মন আছে, দলিত ও আছে। আছে জাতপাত, বর্ণ ও সম্পদের বৈষম্য, দুর্নীতি, দারিদ্র, ভাষার অধিকারের প্রশ্ন, সংস্কৃতির জগাখিচুড়ি- ভারত রাষ্ট্রের যতো দায় বিদ্যমান তার সবই আছে কিট্টুরে। দুই প্রধানমন্ত্রীর হত্যাকান্ডের মধ্যবর্তী সময়ে কিট্টুর তথা রাষ্ট্রভারতের মানুষের জীবনযাপনের গল্প বলে গেছেন অরবিন্দ।
উপন্যাস হিসেবে কেমন?
আহামরি কিছু নয় কিন্তু চমকপ্রদ, অভিনব। অভিনব তার নির্মানে। এরকম চমকপ্রদ নির্মানকৌশল এর আগে কাউকে ব্যবহার করতে দেখিনি, আমি অন্ততঃ।
ছোট্ট করে বলা যাক। শুরু হয়েছে কিট্টুরের তথ্য ও বর্ননা দিয়ে যেমন কোন জনপদের তথ্য বিবরনী দেয়া হয় পর্যটক গাইডে। অরবিন্দ তার পাঠককে উপন্যাসের পাঠক নয় বরং তার তৈরী করা জনপদে পর্যটক হিসেবেই আমন্ত্রন করছেন। সাতদিনের একটা প্যাকেজ ট্যুর ও তৈরী করে দিয়েছেন। আপনি ভ্রমন শুরু করবেন প্রথম দিন সকাল বেলা কিট্টুর রেলস্টেশন থেকে। আপনার সামনে এসে দাঁড়াবে তুখোড় চটপটে এক চাল্লু কিশোর জিয়াউদ্দীন। স্থানীয় হিন্দু হোটেলের কর্মচারী সে,স্টেশন থেকে হোটেলের খরিদ্দার পাকড়াও করা চাকরী তার। নিজের মুসলমানিত্ব নিয়ে তার অশেষ গর্ব, দক্ষিন ভারতের এক গন্ডগ্রাম থেকে ক্ষুধার জ্বালায় শহরে এলেও কল্পনায় সে একজন পাঠান! আপনাকে সে বলবে- I'm a Muslim sir.We dont do hanky-panky'। হ্যাঁ, ইংরেজীতেই বলবে। প্রথম দিনের পুরো গল্প এই জিয়াউদ্দীন এবং তার পরিপার্শ্বের।
এইভাবে সাতদিন সাতরকমের মানুষের গল্প। প্রতিটি গল্প আলাদা। আপনি চাইলে প্রতিটিকেই স্বতন্ত্র গল্প হিসেবে পাঠ করতে পারেন আবার সাতটি খন্ড মিলে একটি পুর্নাঙ্গ উপন্যাস ও ভাবতে পারেন।যেমনই ভাবেন অরবিন্দ তার পাঠকপ্রিয় ভঙ্গী ও ভাষায় আপনাকে ভ্রমন করাবেন সাতদিন। সাতদিনে একটা পুরো জনপদ, একটা পুরো রাষ্ট্র!
'বিটুইন দ্যা এসেসিনেশন' এর রিভিউ লেখা আমার উদ্দেশ্য নয়। যারা রিভিউ পড়তে চান এখান থেকে দেখে নিতে পারেন দ্যা গার্ডিয়ান
নির্মানে চমকপ্রদ ও অভিনবত্ব আছে, পঠনে মসৃন। ভারত রাষ্ট্রের গল্প, তবু আমাদের যাপিত জীবনের ও। আর অরবিন্দ খুব দক্ষ ট্রাভেল কন্ডাকটর, চেনা জীবনে ও আলো না পড়া অনেক অন্ধকার রয়ে গেছে, তিনি সেই অন্ধকারে বিনা ক্লেশে পাঠককে পৌঁছে দিতে পারেন। তবু এই উপন্যাস কি আমি আরেকবার পড়ার তাড়না অনুভব করবো কিংবা ব্যক্তিগত সংগ্রহে রাখার? সম্ভবতঃ না।
কেনো নয়?

দেখা যাক উত্তর পাওয়া যায় কিনা আপাতঃভিন্ন আলোচনায়।
ভালো লেখকদের আমি মোটাদাগে দুভাগে ভাগ করি। প্রথম ভাগের লেখকরা আবার তিনরকম। একরকম ভালো লেখকেরা পাঠককে নিয়ে যাত্রা শুরু করেন চেনা ও মসৃন পথে যেনো পাড়ার ছোট্ট পার্ক কিংবা শহরের চেনা নদীর পাড়। লেখকরা পুরোটা সময় পাঠকের পাশাপাশি থাকেন,পাঠককে ও তার পাশে থাকার জন্য জায়গা করে দেন। পাঠক ও লেখক মিলে আনন্দ, বেদনা, ক্ষোভ, হাস্য,হর্ষ, বিমর্ষতা ভাগাভাগি করেন।সবকিছু 'স্মুথ' থাকে। এরকম লেখকদের লেখা পাঠের জন্য পাঠকের প্রস্তুতির কোন প্রয়োজন পড়েনা। ফলে বেশীর ভাগ পাঠক খুশী। এরকম ভালো লেখকেরা তুমুল জনপ্রিয় হন। অরবিন্দ আদিগার 'বিটুইন দ্যা এসেসিনেশন' বিক্রী হয়েছে ১৬,০০০ কপি!
দ্বিতীয়রকমের ভালো লেখকেরা একটু এডভেঞ্চারাস। চেনা মাঠ, চেনা পথ ছাড়িয়ে এরা পাঠককে একটু অচেনায় নিয়ে যান। তবে খুব দূরে কোথাও নয় হয়তো শহরের শেষসীমানার উঁচু টিলা, বড়জোর ঝোঁকের বশে অন্য কোন শহরে। এরা পাঠককে কিছুটা ভাবান, কিন্তু পাঠক ভাবনায় একেবারে হারিয়ে যায়না দিনের শেষে সে নিজের নিরাপদ ঘরেই ফিরে আসে। ব্যতিক্রম দু একজন হয়তো এডভেঞ্চারের লোভে আবারো অচেনা পথে পা বাড়ায় তবে বেশির ভাগ পাঠকই শেষপর্যন্ত ঘর-গেরস্ত! ঘর-গেরস্তালীর ফাঁকে তারা হয়তো একদিনের এডভেঞ্চারের স্মৃতিচারন করে। ঐ অতোটুকুই ব্যাস।

তৃতীয় রকমের ভালো লেখকেরা সাংঘাতিক, ভয়ংকর, বিপদজনক। স্বভাবতইঃ সংখ্যায় কম। এদের সাথে যাত্রা শুরু করতে হলে পাঠকের প্রস্তুতির প্রয়োজন। যথেষ্ট প্রস্তুতি নিয়ে শুরু করতে পারলে এই ভয়ংকর লেখকদের হাত ধরে পাঠক পৌঁছে যাবে এমন দিকশূন্যপুরে যেখান থেকে প্রত্যাবর্তনের আর কোন পথ থাকেনা। এরা হচ্ছে সেই লেখকেরা যারা লেখার মাধ্যম পাঠকের মনোজগত বদলে দিতে পারে।
এবার আসি দ্বিতীয় ভাগে। এভাগে লেখকরা দুরকম।
প্রথমরকমের লেখকেরা হলেন বিয়ারের মতো। অতো আয়োজনের কিছু নেই। গ্রীষ্মের বিকেলে বাগানে কিংবা সমুদ্রতীরে বসে সহজেই চুমুক দেয়া যায়। মাত্রাভেদে এলকোহল কমবেশী থাকতে পারে। কোনটা ৪%, কোনটা ৫%। কোনটা বেশী চিলড, কোনটা বেশী সল্টি। তবে শেষপর্যন্ত কোনটাই উলটো লাথি মারেনা, যুক্তি-টুক্তি নিকেশ করে দেয়না, বেশ ক'টা টেনে-হালকা একটু আবেশ নিয়ে শেষপর্যন্ত ঝুটঝামেলা ছাড়াই চেনা রাস্তায় হেঁটে বাড়ি ফেরা যায়।
হুমায়ূন আহমেদ-শহিদুল জহির- গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ এরা হলেন এই গোত্রের ভালো লেখক।

এইভাগের দ্বিতীয় রকমের লেখকেরা হলেন কড়া এলকো। ৫৫% এর পারনড কিংবা ৪৫% এর স্মৃনফ। না হলে নিদেনপক্ষে ৪০% এর জ্যাক ডানিয়েল। এরা সহজপাচ্য নয়, মৃদু ফুরফুরে আবেশ ছড়ায়না। বরং উলটো লাথি দেয়, ভেতর থেকে বেরিয়ে আসতে চায়। অপরিচিত অস্বস্তি ও অনুভূতিতে আক্রান্ত করে। কিন্তু একবার আস্বাদন করতে পারলে, একবার সেই মোহময় পতনে নিজেকে মুক্ত করতে জানলে অনুধাবন করে ফেলা যায় জীবন আসলেই অন্যত্র!


ইলিয়াস-কাম্যু-কুন্ডেরা এরা সেই মায়াবী ঘাতক।

No comments: