Wednesday, July 16, 2008

তক্ষক

১।
আইপডটা কানে গুঁজে দেবো কিনা ভাবছি ।

নিতান্ত অভদ্রতা হয়ে যায়, কিন্তু কোনো বিকল্প খুঁজে পাচ্ছিনা । বয়স্ক ভদ্রলোক একটানা কথা বলে যাচ্ছেন ।
কথা বলা শুরু করেছেন অন্ততঃঘন্টা খানেক । আমি কিছুটা বিস্মিত ও হচ্ছি বটে । এই শীর্নশরীরের প্রায় বৃদ্ধ মানুষটা এতো কথা বলার শক্তি পাচ্ছেন কি করে?

যাচ্ছি ট্রেনে । এক জেলা শহরে চাকরীর ইন্টারভিউ দিতে । সুন্দর রোদেলা দিন । ট্রেনে ভীড় কম । জানালার পাশে বসেছি। পাশের সীট খালি ছিলো । চমৎকার বাতাস ।আইপডে লোপামুদ্রার গান । উপভোগ করছিলাম ।
প্রতীতির কথা মনে পড়ছিলো । পড়শু ডেটিং হলো আসিফের ফ্ল্যাটে । মেয়েটার বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে । গল্প এখন শেষ পর্যায়ে । আমাদের কোনো দায়বদ্ধতা নেই,ছিলো ও না কোনোদিন । তবু হয়তো আমার মনে পড়বে প্রতীতিকে, প্রতীতির ও আমাকে মনে পড়বে কোনো অবসরে ।
প্রতিবার ডেটিংয়েই প্রতীতি আমাকে শরীর দেয় আর দেয় এক একটা চমৎকার কবিতার বই । ও মেয়ে নিজে কবিতা টবিতা পড়েনা কিন্তু আমাকে পড়ায় । সম্পর্ক হওয়ার আগে কোন একদিন বোধ করি ওকে জানিয়েছিলাম আমি, কবিতায় আমার প্রেমের কথা । আমার অনেক কিছুতেই পরে ও আর বিশ্বাস রাখেনি, কিন্তু এই অপ্রয়োজনীয় ব্যাপারটা মনে গেঁথে রেখেছে ।

ব্যাগ খুলে কবিতার বইটা বের করি । জয় গোস্বামীর কবিতা সংগ্রহ । আমি জয়ের কবিতার তেমন ভক্ত নেই । বড্ড বেশী লিরিক্যাল । তবু এই ছুটেচলা রোদেলা দুপুর, প্রায় নির্জন রেলের কামরা, হুহু বাতাস- আমি প্রতীতির প্রতি প্রেম ও কবিতার প্রতি কামবোধে আক্রান্ত হই ।

আইপড খুলে গলায় ঝুলিয়ে রাখি । বিশ্রাম নাও লোপামুদ্রা। ইতঃস্তত পাতা উল্টাই । বিন্যস্ত অক্ষর ও ছন্দের সমাবেশ । একটা পাতায় চোখ আটকায়ঃ

' একফোঁটা রক্ত শুধু ঝরে পড়ল,মাটি ফেটে গেলো আঘাতে?
শিশুদের মরামুখ ভেসে উঠল কি একবার?
তা কেউ দেখেনি,বড় মেঘ করে এসেছিল ।
নইলে দেখা যেত এই ফাঁকা
খেয়াঘাটে
চাঁদ চেপে ধরে আছে রক্তে ভেসে যাওয়া নাড়ী তার ।'

কেমন । কেমন যেনো লাইনগুলো ।অকারনে আমার গা কেঁপে উঠে ।

২।
-'দেখলেন ঘটনা । এইবার কিন্তু খেলা জমবো । সব চোর ধরা পড়তেছে'
ভদ্রলোক আবার কথা শুরু করেছেন ।
তার কোলের উপর কটকটে হলুদ রংয়ের খবরের কাগজ । এই আরেক আপদ শুরু হয়েছে আজকাল । ত্রানের টিন,রিলিফের কম্বল,ঘুষের টাকা,তেরশো নদী,ছাপান্ন হাজার বর্গমাইল গিলে খেয়ে ধরা পড়ছে বন কর্মকর্তা,পুলিশের দ্বিতীয়কর্তা,রানীমাতার জৈষ্ঠ্য সন্তান । আর এইসব নিয়ে সিনেমা সিনেমা গল্প জুড়ে দেয়া চায়ের টেবিল থেকে ট্রেনের কামরা পর্যন্ত । বিরক্ত লাগে । যন্ত্রনাময় দিনকাল ।
-'আল্লাহর রহমত ছিলো, তাই দেশটা বেঁচে গেলো । আগামী ২০ বছর সেনাবাহিনীর ক্ষমতায় থাকা দরকার,কি বলেন?'

আমি মনে মনে গালি দেই । 'মর্ষকামী ভোদাই পাবলিক' । এই সব পাবলিকের কারনেই হাঁটুতে ঘিলুওয়ালারা ছড়ি ঘোরায় । যখন তখন রাস্তায় কানধরে উঠবস করাবে তবু পাবলিকের প্রীতি দূর হয়না ।
মুখে কিছু বলিনা । খামোখা কথা বাড়িয়ে লাভ নেই । আর দিনকাল আসলেই খুব সুবিধার না ।

ট্রেনের গতি কমে আসছে । প্লাটফর্মে ঢুকতে আর খুব দেরী নেই । ভদ্রলোক কোমর উঠানো শুরু করেছেন । এবার তার ব্যাগ গোছানো শুরু করবেন নিশ্চিত । ট্রেন থামার আগেই দরজায় গিয়ে ভীড় জমাবেন, সেটা ও নিশ্চিত প্রায় । মনে মনে আরেক প্রস্ত গালি দেই ।
-'তা বাবাজী এসে গেলাম প্রায় । অনেক কথা বললাম । কিছু মনে করেননি তো । আমারো একটা ছেলে আছে । আপনার বয়সীই হবে । না , আপনার চেয়ে আরেকটু বড়ো'
অর্থহীন কথা । আমি আতংকিত হই । নতুন কোন গল্প শুরু হয় বোঝি ।
-'তবে আমার ছেলেটা আপনার মতো নয়'
-আমার মতো নয়, মানে?

নিজের অজান্তেই এই প্রথম আমি তার কথার জবাব দেই ।
-আমার ছেলেটা পংগু । একটা মাত্র ছেলেই আমার
সর্বনাশ । লোকটা এখন পংগু ছেলের গল্প ফেঁদে সাহায্য না চাইলেই হয় ।পোষাক আষাকে ভদ্রলোক যদি ও । বিশ্বাস কি? যা দিনকাল পড়েছে । আমার আর কথা না বাড়ানোই নিরাপদ ।

তবু কি আশ্চর্য! আমিই পালটা প্রশ্ন করি । আমার কন্ঠ কি কিছুটা আর্দ্র?
-দুঃখিত । কি হয়েছিলো ওনার? কোন অসুখ,কোন দুর্ঘটনা?
-দুর্ঘটনা? হ্যাঁ । তা দুর্ঘটনা ও বলতে পারেন
কি এক অদ্ভুত কারনে আমার খুব আগ্রহ হচ্ছে এই বৃদ্ধের পংগু ছেলেটার কথা জানতে ।
-বলুন না প্লিজ? কি হয়েছিলো?
-১৯৯০ । মনে আছে বাবাজী? বয়স কতো তখন? ১০/১২? আমার ছেলেটা তখন ১৮ । কলেজে পড়ে । আন্দোলন করে । আর্মি পিটিয়ে ওর কোমরের হাড় আর দুপা ভেংগে দিয়েছিলো। বুট দিয়ে থেঁতলে দিয়েছিলো ওর পুরুষাংগ'

আমি বেদনার্ত হই । অন্ততঃ হওয়া উচিত । একজন বাবার মুখ ঝুলে পড়েছে তার একমাত্র পুত্রের পংগুত্বের গল্প বলতে গিয়ে ।
কিন্তু আমি বেদনার্ত হইনা । এই বকবকে বুড়ো একটু আগেই বলছিলেন এই দেশে যেনো আরো ২০ বছর সেনা শাসন থাকে । এই বুড়োকে আমি মনে মনে গালি দিয়েছিলাম 'মর্ষ্কামী ভোদাই' বলে ।আমার এবার তাকে শুনিয়ে শুনিয়ে গালি দিতে ইচ্ছে করে
-আমি দুঃখিত । কিন্তু আপনিই আগে বললেন অন্ততঃ আরো ২০ বছর সেনাশাসন দরকার । অথচ আপনার ছেলে ওদের হাতেই । আসলে আপনাদের মতো মানুষদের জন্যই...'

ট্রেন প্লাটফর্মে ঢুকছে এবার । গতি প্রায় থেমে এসেছে । বৃদ্ধ তার ব্যাগ গুছিয়ে হাঁটা শুরু করে দিয়েছিলেন । ফিরলেন । ফিরে এলেন আমার কাছে । আমার চোখে চোখ রাখলেন । কেমন ঘোলাটে । গা শিউরে উঠে । গলা নামালেন । হিসসিস করে বললেন-
২০ নয়, ২০০ বছর ধরে আমি আর্মির শাসন চাই । প্রত্যেক মা-বাবার একটা করে ছেলে গুলী খেয়ে মরুক নয়তো পংগু হয়ে পড়ে থাক বিছানায়, আমার ছেলের মতো ।

বাইরে চমৎকার রোদ । তবু কেনো জানি সহসা তীব্র শীতের কাঁপুনি আমার সমস্ত জুড়ে। গন্তব্য পৌঁছে গেছি । উঠা দরকার । উঠতে পারছিনা । পারছিই না আর ।


[ সচলায়তনে প্রথম প্রকাশিত । সচলায়তন গল্প সংকলন এ মুদ্রিত ]

Thursday, July 10, 2008

আদমের ঘর-সন্ন্যাস

(এই গল্পটা দশবছর আগের লিখা । পাপড়ি রহমান ছাপিয়েছিলেন তার সাহিত্যকাগজ 'ধূলিচিত্র' এ । এইরকম লেখা এখন আর লিখিনা অথবা লিখতে পারিনা আর।
তবু তো এ আমারই লিখা , তুলে রাখলাম তাই নিজের ব্লগে ।)



ক’দিন থেকেই এমন হচ্ছে।
ঘুম ভাঙতেই প্রচন্ড তৃষ্ণা পাচ্ছে, অথবা তৃষ্ণা পেয়েই ঘুম ভাঙছে ।
বিছানা থেকে প্রায় গড়িয়ে নামে হাসান। দেয়াল ঘড়িতে চোখ যায় দ্রুত। সকাল নটা বেজে কুড়ি। দরজার ছিটকিনি ভেতর থেকে নামানো। তার মানে ঘুম না ভাঙিয়েই রজব আলী চলে গেছে।
রজব আলী বাড়ি গেছে। রজব আলী বাড়ি যাচ্ছে মেঘনার বুকে ভেসে। আহ্ মেঘনা!
চোখের সামনে নদীটা ভাসতেই হাসানের মনে পড়ল বিছানা থেকে নেমেছে সে গলা ভেজানোর জন্য। টেবিলের ওপর রাখা জগটা উপুড় করে ধরল গলায়। এক সেকেন্ড... দু সেকেন্ড.. পানির ফোঁটা পড়ল না। প্রায় দৌড়ে এবার বেসিনের ট্যাপ ঘোরাল। নেই! ..হ্যালো ওয়াসা পানি নেই, ...মিষ্টার মেয়র আমার পানি নেই, ...জাতির ত্রাতাগন আমার জন্য একফোঁটা পানি নেই...।

হাসানের তৃষ্ণা বাড়তে থাকে। আর তৃষ্ণা মাত্রই তো বর্ধনশীল। একবার পেলে কেবল বাড়তেই থাকে। আকাশ-পাতাল দৈর্ঘ্যের তৃষ্ণা বুকে পায়চারি করতে করতে হাসান হঠাৎ লাথি বসাল শূন্য জগে। জগটা শূন্যে ঘুরতে ঘুরতে গিয়ে পড়ল ঘরের এক কোণে, সেখানে এক মানুষ সমান দৈর্ঘ্যের আয়না বসানো। আয়নাটা বড় শখের ওর।
শখের আয়নার সামনে এসে দাঁড়াল হাসান।

আয়নার ভেতরে এক জীবন্ত স্লাইড। ওর চোখে চোখ রাখল সে। চোখ দুটো ক্রমশ তীক্ষন এবং দৃষ্টি কঠোর হয়ে যাচ্ছে। চোখের মণি আজকাল জ্বলজ্বল করে জ্বলে। আজকাল নিজেকে বেশ সু-পুরুষ মনে হয়। আগের সেই নরম নরম চেহারাটা ভেঙে কেমন যেন ধারালো হয়ে উঠছে। তবে বেশ শীর্ণ ও । শরীরে এক ফোঁটা মেদ নেই। এ নিয়ে অবশ্য কোনো দুঃখবোধও নেই ওর, হাসান ভেতরে আগুন ধারণ করে আর আগুন মাত্রই পোড়ায় সমস্ত মেদ, যাবতীয় বৈভব।

আয়নার ভেতরে স্লাইড বদলায়।
ঠোঁট টিপে নিঃশব্দে হেসে ওঠে এক কিশোরী। চৈতী এমন করেই তো হাসত। ওই হাসি আধ বোঁজা চোখ, ঠোঁটের ভাঁজ- এসব নিয়েই তো হাসানের প্রথম কৈশোর। যেমন সবারই থাকে। আসলে কমবেশি সব মানুষের গল্প তো সেই একই রকম। তবু কেন যে মানুষের এত মৌলিকত্বের, এত অনন্যতার আবদার। চৈতীর মেয়ে নাকি এখন স্কুলে যায়। সেই চৈতী, স্পর্শের আগেই যে কেঁপে উঠত। চৈতীর মেয়ে এখন স্কুলে যায়! হাসানের ভাবনায় চৈতী এখনো তবু সেই বেণী দোলানো কোমল কিশোরী । হাসান কথা বলে ওর সাথে
-চৈতী!
-উঁ!
-ফিরিয়ে দাও।
- কী?
- আমার কৈশোর।
- কী?
- তোমার দোলন চাঁপা।
- কী?
- তোমাকে দেয়া আমার আবেগের সমস্ত অনুবাদ
- কী?
- কিছু না। কিছু না গো মেয়ে। কিছু না!

হাসান ওকে ক্ষমা করে দেয়।

সাথে সাথে স্লাইড বদলায়।
এবার এক উচ্ছ্বল তরুণী। ঝলমলে একুশ বছর। প্রানোচ্ছল প্রতীতি। বিশ্ববিদ্যালয়ের রোদ্দুর মাখা দিনগুলোর বেহিসেবী অংশীদার। প্রতীতির সাথে কাটানো ওই দিনগুলোতে সে বুকভরে নিঃশ্বাস নিতে পারত। তখন ঘননীল হয়ে যেত আকাশ, বাতাসের গভীরে আরো স্নিগ্ধ হয়ে বইত বাতাস, কচি সবুজ ঘাসে ঢেকে যেত আদিগন্ত পৃথিবী। প্রতীতি যেন তখন এক লঘূ মরালী। হাতছানি দিয়ে হাসানকেও ডাকত ডানা মেলে একসাথে উড়বার জন্য। হাসান ওড়েনি তখন। তবে ডান ঝাপটিয়েছে। ডানা ঝাপটানোর শব্দে বুঝাতে চেয়েছে- ‘উড়তে আমি পারি। কিন্তু উড়ব আমার ইচ্ছেয়। কেবল আমার ইচ্ছেতেই’। প্রতীতি প্রতীক্ষা করতে চেয়েছিল, প্রতীক্ষা করেছিল ওর ইচ্ছের। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কেন জানি ইচ্ছেটাই জাগেনি আর। আসলে ওসব ভালো লাগে না ওর, অন্ততঃ ভালো লাগত না তখন, জীবনটা যখন আরো বছর কয়েকের সজীব ছিল।
তখন মনে হতো প্রত্যেকটা মানুষ একেকটা নদীর মতো যে যার নিয়মে বয়ে যায়, কেউ কারো জন্য প্রতীক্ষায় থাকে না, থাকতে পারে না।হ্যাঁ হয়, কারো জন্য কারো হয়ে যায়। যেমন সমুদ্রে যেতে যেতে মোহনায় কোনো নদীর দেখা হয়ে যায় অন্য কোন নদীর সাথে। কিন্তু এ তো হঠাৎ ঘটে যাওয়া ঘটনা মাত্র এতে কারোরই কোনো কৃতিত্ব থাকে না।

তবে সাতাশ বছরের চৌকাঠ দাঁড়িয়ে ওসব একুশে দর্শনে ফাটল ধরেছে হাসানের। আজকাল মনে হয় -হয়তো পারে মানুষ, হয়তো ইচ্ছেটাকে আরো শানিত করতে পারলে । মানুষ হয়তো কিছুটা নদীর মতনই, কিন্তু নদী তো আর না। এসব ভাবনা শিরদাঁড়া হয়ে চিন্তায় প্রবেশ করতেই হাসান কথা শুরু করে আয়নার ভেতরের একুশ বছরের সাথে
-তোমাকে খুব মনে পড়ে প্রতীতি।
- মিথ্যে!
- সেই ১৩ নভেম্বর, ফরেষ্টহিল, ক্যাডবেরী চকলেট... সব মনে পড়ে।
-মিথ্যে!
-তোমাকে এখনো ভালোবাসি।
-মিথ্যে
- হ্যাঁ মিথ্যে । আমি কাউকে ভালোবাসি না, বাসিনি কোনোদিন। আমাকে নির্বাণ করে, এত জল ধারণ করে না কোনো সরোবর।

আয়নার ভেতরে প্রতীতির ছায়া ম্লান হয়ে যায়। হাসানের হঠাৎ জেগে ওঠা পুরনো অহং প্রতীতিকে মুছে দেয় সহজেই।

প্রতীতির বদলে এবার নতুন স্লাইড। আয়নার ভেতরে ঝলসে ওঠে টান টান যৌবন। মাংসল উদ্দামতা, লিপষ্টিকের হাতছানি।রক্তে বানডাকা সুগন্ধী... এবং উর্মিলা চৌধুরী। হাসান যে কোম্পানীতে কম্পিউটার অপারেটরের চাকরি করে মেয়েটা সেখানে শোভাবর্ধন করে। ভালো মাইনে পায় সে এবং ভারীক্কী একটা পদবিও আছে তার। ‘পি.আর.ও-পাবলিক রিলেশনস অফিসার’। হাসান অবশ্য বলে ‘বি.আর.ও-বায়ার রিক্রেশনস অফিসার’। সাদা চামড়ার, ভুঁড়িওয়ালা, চান্দিছিলা, যত বায়ার আসে সকলের রিক্রেশনের জন্যএই উর্মিলা চৌধুরী। সে যত আনন্দ বিলায় চেহারায় তত তার ঝিলিক বাড়ে, শরীরে তত বেশি আবেদন জাগে।

মাঝে মাঝে কম্পিউটার রুমে আসে সে এটা-ওটা প্রিন্ট করতে। যখন ফিরে যায়, আজন্ম তৃষ্ণা নিয়ে হাসান তাকিয়ে থাকে তার গমনে। এই উথাল-পাতাল আলোড়নে শরীরের ভেতর ভীষণ রকম জল ভাঙে। শরীর আজকাল ওকে খুব অসহায় করে ফেলে অথচ প্রতীতিকে বুকে জড়িয়ে রেখে ও কেমন শান্ত, স্নিগ্ধ, নির্মোহ হয়ে থাকতে পারত ও একুশ বছর বয়সে। সেই পবিত্র একুশে!
একুশ বছরকে মনে রেখে হাসান এবার চোখ তোলে আয়নার ভেতরে উর্মিলার আগ্রাসী ইমেজে

-খুব কি সুখ পাও মেয়ে, এই সবে?
-জানি না!
-কষ্ট কি পাও না কখনো?
- জানি না!
- স্নানের জলে হাত ডোবালে মাঝে মাঝে কান্না পায় না?
-জানি না!
আসলেই জানো না। আমিও তো জানি যে এসব জানো না তুমি, তোমরা কেউ। বাম পাঁজরের অন্তর্দহন, অনুভূতির বিবসন এসব তোমাদের জন্য নয়। পৃথিবীর সমস্ত বিষের বালি, নীল বুদবুদ কেবল আমাদেরই... কেবলই আমার।



[২]

ঘর থেকে যখন বেরোল হাসান, ছায়া তখন ঠিক পায়ের কাছে।
সূর্য জ্বলছে মাথার ওপর । সকালে ঘুম ভাঙার পর থেকেই বুঝতে পারছে আজ আবার মাথার ভেতর ক্ষ্যাপামী শুরু হয়েছে- অনেক দিন পর। বয়স যখন আরো কম ছিল, পৃথিবীকে যখন আরো স্বপ্নময় মনে হতো, মনে হতো সব ‘সম্ভব-না’ গুলো ঠিক ঠিক একদিন ‘সম্ভাবনা’ হয়ে উঠবে- ওই রকম সবুজ সময়ে এসব ক্ষ্যাপামী প্রায়ই জড়িয়ে ধরত ওকে।
তুমূল আড্ডা, জোরালো যুক্তিতর্ক, হাত-পা ছোঁড়াছুড়ি, শেয়ারবাজার, শমী কায়সার, ভার্চুয়াল রিয়েলিটি... এরই মাঝখান থেকে সে হঠাৎ উধাও। গনগনে দুপুরে একা একা হেঁটেছে শহরের সমস্ত পথজুড়ে। কোনোদিন প্রতীতিকে নিয়ে সারাদিন টই টই, শহর ছাড়িয়ে দূরে কোথাও। ক্যাডবেরী চকলেটে কামড় বসিয়ে বলেছে- ‘দেখিস ক্যাডবেরী কোম্পানি যেদিন উঠে যাবে সেদিনও আমার দাঁতের কামড় রয়ে যাবে। যেদিন তুই অনেক দূরে চলে যাবি, সেদিনও তোর ভেতরে আমি রয়ে যাব।’ অনার্স ফাইনাল পরীক্ষার আগের রাতে ছাদের ওপর গাঁজার আসর। ‘ধ্যাত ভাল্লাগছে না!’ বলে কমন প্রশ্ন ছেড়ে আসা এসব একজনকেই মানাত। কিন্তু সেই হাসান পৃথিবীতে নেই আজ, ক্ষ্যাপাটে পাগলামির ওই শহরটাও নেই, নেই সংগীসাথীরা কেউ।

যেন স্বর্গের বাগান থেকে নির্বাসিত আদিম পুরুষ সে। নিজেকে জেনে ফেলার অপরাধে বন্দী এখন এই ইট-কাঠ- পাথরের নোংরা নগরে। সপ্তাহে ছয়দিন কেটে যায় কি-বোর্ড, মাউস,প্রিন্টারে। প্রত্যেক ছুটির দিনে রুমমেট রজব আলী বাড়ি ছোটে তার আদরের টুনটুনি বৌ-র টানে। হাসানের কোথাও যাওয়া হয় না। এই একদিন সে ঘুমোয় নয়তো অমুক-তমুক চ্যানেলে রকমারি নাচ দেখে মাঝে মাঝে বাথরুমে যায়, শরীরটাকে একটু হালকা করে নেয়। চাকরিতে ঢোকার দুবছর থেকে এই হলো তার মোটামুটি জীবন যাপন। খারাপ কী, ভালোই তো যাচ্ছিল, কেন যে আজ আবার সেই পুরনো ক্ষরণ, রক্তের উন্মাদনা, ডাকপিয়নের হলুদ চিঠি। পাশ দিয়ে যন্ত্রদানব ছুটে যাচ্ছে। কালো ধোঁয়ার উৎপাত। জ্যাম, জট, মঘা ইউনানীর লিফলেট, গোপন অসুখের প্রকাশ্য ক্যানভাস, রিকশাওয়ালার ঝগড়া, গাড়িওয়ালার গালাগালি, ট্রাফিকের অসহায় বাঁশী- কিচ্ছু যায়-আসে না, আজ কিচ্ছু যায়-আসে না হাসানের।

পুরনো গুহায় ঢুকেছে সে আজ। শরীর থেকে খুলে ফেলেছে গজিয়ে ওঠা সামান্য আগাছা । সে জানে এর কোনো মানে নই। ‘কিসের কী মানে আছে হে?’ যা কিছুর মানে নেই তার মানেই খুঁজে বের করো’- কে যেন বলেছিল কথাটা। পৃথিবী জুড়ে এত কথা, যায় কোথায় এত কথা? মানুষের সমস্ত কথা নাকি ছড়িয়ে পড়ে ইথারে। ওখানে থেকে ফিরিয়ে আনা যায় না? যদি আনা যেত তাহলে ওকে দেয়া সবার সব কথা সে ফিরিয়ে দিত। ‘আমাকে এত কথা দেয়া কেন? আমি তো কাউকে কোনো কথা দেইনি কোনোদিন। আজন্ম সার্বভৌম আমি, কারো কাছে আমার কোনো দায় নেই। ঈশরের মতো নিঃসংগ ও অপরিবর্তনীয় আমি। যখন অনেক বন্ধু ছিল আমার, চৈতী ছিল, প্রতীতি ছিল, উর্মিলা আছে, যখন অমুক-তমুক থাকবে তখনো ঠিক এ রকমই রয়ে যাব আমি। কেউই কোনোদিন স্পর্শ করতে পারেনি, কোনো কিছুই বদলাতে পারেনি খুব গহীনের একান্ত আমাকে। বদলাতে পারেনি বলেই অর্থহীন ঘুরে বেড়াতে পারি এখনো, ঘুরে বেড়াতে পারি কোনো ধান্দা ছাড়াই।’

এই সব ক্ষ্যাপাটে স্বমেহন (!) হাসানকে টেনে নিয়ে যায় কালো পিচের রাস্তা ধরে। গনগনে রোদ মাথার ওপরে। পায়ের কাছে খাড়া ছায়া। বাম হাতে ওর ঘড়ি প্যাঁচানো আছে। আজ সারা বেলা অনন্ত ছুটি। ঘড়ি তো কেবলই বাহুল্য । বাহুল্য দ্বি-প্রহরের ক্ষুধা-তৃষ্ণা।
একটা বাহারী পোষ্টারে চোখে পড়ে ওর। প্রিয়ংবদা প্রিয়দর্শিনীর চিত্রপ্রদর্শনী, ‘প্রিয়ংবদা প্রিয়দর্শিনী’! বড়ই রঙিন নাম। দর্শনে প্রিয় না হলে কি আর বাজার মাত হয়?
পোষ্টারে আবার উদ্বোধকের নামটাও বড় করে ছাপা । নামটা পরিচিত নয়। হবে হয়তো কোন কুটনীতিক, মন্ত্রী কিংবা শিল্পপতি। ‘শিল্পী আর শিল্পপতি’ – বড় চমৎকার সহবাস হচ্ছে আজকাল। হবে না-ই বা কেন? পতিরাই তো ভোগ করবে শিল্প আর শিল্পীর শরীর।

হাসানের মনে পড়ে যায় এক সময় সেও লিখত। কবিতা- ভালোবাসাএবং দ্রোহের । তারপর এল গল্প- ছোট, বড়, মাঝারী। ‘আবার শুরু করলে কেমন হয়?’ মনে মনে ভাবে সে। অনেক দিন থেকেই ওর একটা গল্প লেখার ইচ্ছে। এক পথিকের গল্প। পথ চলতে চলতে সে পথিক পাথর কুড়োত। লাল পাথর, নীল পাথর, কাঁচা হলুদ রঙের পাথর, মাঠের ঘাসের সবুজপাথর। কুড়োনো পাথরে ভর্তি হলো তার জামার পকেট, কাঁধের ঝোলা। এরপর দুহাত, তারপর? তারপর পথিকের উদ্ভ্রান্ত সময়। সামনে এখনো অনেক ভালোলাগা পাথর, কিন্তু তার যে আর ঠাঁই নেই।

গল্পটা শুনতে গিয়ে ফিক্ করে হেসে ফেলে হাসানের ছায়া
-হবে না হে! তোমাকে দিয়ে গল্প-টল্প হবে না।
-কেন, হবে না কেন? আমি তো মিথ্যে লিখবো না, ওই পথিক তো চেনা আমার।
-তবু হবে না, তোমাকে লিখতে হবে টক-ঝাল-মিষ্টি, বালিকা প্রিয় প্যাকেট সাইজ গল্প, তবেই হবে।
- কী হবে?
-নগরে সুরম্য প্রাসাদ হবে, আকাশ চ্যানেলে তোমার গল্পের নাট্যরূপ হবে, সাজানো-গোছানো শিল্পকন্যাগণ তোমার সাথে লং ড্রাইভে যাবে দামি গাড়িতে চড়ে।
-কিন্তু সেই পথিক, তার কী হবে?
-সে তোমার গাড়ির নিচে চাপা পড়ে মরবে !


[ ৩ ]

উদ্যানে এখনো ছিটে-ফোঁটা বৃক্ষ আছে। বৃক্ষের শরীর কেটে বানানো বেঞ্চে হাত-পা ছড়িয়ে বসে হাসান। চাঁদ উঠছি উঠছি করে উঠছে না কেন জানি ।
আর, সে আসে। নিজস্ব ভথিতে। যেমন করে আসে তারা।

-‘নিবেন?’
একা ঘর। রজব আলী ছুটে গেছে তার টুনটুনি বৌ-এর কাছে। চৈতী, প্রতীতি প্রত্যেকে নিজেদের ঠিকানায়, উর্মিলা উত্তাপ ছড়াচ্ছে কোনো দামি রেস্তোরাঁয়।
হাসান কোথায় যাবে? কার কাছে যাবে? পকেটে হাত দেয়। টাকা আছে। ওটা থাকলে সবই তো হয়।
যে কাউকেই নেয়া যায় ইচ্ছে মতন। আর নেয়া মানে তো যাওয়াই । যাওয়া এবং আসা, যাওয়া-আসা। যাতায়াত, পিচ্ছিল যাতায়াত।
-সারারাত। কত নিবা?
-কয়জন?
-একা।
-দিয়েন!

হাসান একটি রিক্সা নেয়। চাঁদ উঠেছে। ঝিরঝির বাতাস। মেয়েটা ওর বাম পাশে। হাসান কখনো মেয়েদের বামে বসে না। মেয়েটার চুল একটু একটু করে বাতাসে উড়ছে। ভাললাগছে। ভীষণ ভালথাগছে। মনে হচ্ছে এই তো সবুজ সন্ন্যাস। এই তো গৃহ স্বর্গের বাগান। মাটির মোহর।
‘ কী নাম তোমার গো মেয়ে? চৈতী, প্রতীতি নাকি পপি, শাবনূর?’ নাম একটা হলেই হয়, না হলেই বা কী হয়। হাওয়ার নাম কে রেখেছিল? আদম! আদমের নাম? ঈশ্বর! ঈশরের নাম? মানুষ।
আমি মানুষ। আমরা মানুষ। আমাদের আর কোনো নাম নেই। নেই ভিন্ন অতীত। আমি আদিম পুরুষ। তুমি বিবি হাওয়া। আজ সারা রাত আমরা বিভোর হবো গন্ধমের নেশায়। আমরা সৃষ্টি করব প্রাণ। আমাদের সন্তানেরা মগ্ন থাকবে কৃষির সারল্যে। চিনবে না তারা শিকারের উন্মাদনা, হবে না তারা সভ্যতার সচ্ছল শিকার।

তিন চাকার স্বপ্নযান ছুটে চলে গৃহে,সন্ন্যাসে ।।