Monday, September 25, 2006

একটি কল্পদৃশ্য অথবা নিছক মৃত্যু

”...এসব জটিলতাই ঘূণ পোকা আমার।... মানুষ হিসেবে জম্ম নিয়ে মানুষ হয়ে বেঁচে থাকতে না পারার কষ্ট যে কি ভীষণ! কেন যে আমার কিছুই ভালো লাগে না! না নারী, না কাব্য, না চকচমকে ক্যারিয়ার... কিচ্ছু না! স্বপ্ন আর বাস্তবতার অসহ্য বৈপরীত্য আমাকে ভাঙে। কেবলই... নিজের ভেতর...”

ডায়েরির পাতা জুড়ে এভাবেই একজন সাজিয়েছিল নিজেকে এলোমেলো । এখন নেই।
লাশ হয়ে গেছে কাল রাতে। সাদা কাফনে মুড়ে শুইয়ে রাখা হয়েছে সামনের উঠোনে। কালো গেট ঠেলে আসছে অনেকেই। জানা- অজানা, চেনা-অচেনা।

কে মন্ত্রণা দিয়েছিল ওকে এই সর্বনাশের? জীবনানন্দ না কায়েস আহমেদ, নাকি মায়াকোভস্কি-আত্নহননের নিপুণ শিল্পী? ২১টা সোনেরিল মুখে দেবার সময় করো কথা বুঝি মনে পড়েনি! মনে পড়েনি মাকে? যিনি ঈশ্বর ছিলেন ওর কাছে! অথবা আমাদের কাউকে? যারা বন্ধু ছিলাম...!

লাশটাকে জড়িয়ে ধরে চিৎকার করে কাঁদছে অপালা, ক্লাসের সবথেকে শান্ত মেয়েটা। এই লাশ একদিন অপালাকে বলতে চেয়েছিল ’--- তুমি কি আমার জন্য প্রতীক্ষা করবে? ’ কেন জানি বলা হয়নি। অথবা কি বলা হয়েছিল? নারী অধিকার নিয়ে ভীষণ সোচ্চার লীনা। খুব খুনসুঁটি হতো এসব নিয়ে। নয়নের কাঁধে মাথা রেখে লীনা এখন কাঁদছে। আর প্রতীতি! সবচেয়ে উচ্ছল মেয়েটা নির্বাক বসে আছে মুখ ঢেকে। ওর বুঝি সেই চিঠিটার কথা মনে পড়ছে যেখানে এই লাশ একদিন লিখেছিল ’---তুই আমার ওয়েসিস হবি? ভীষণ ক্লান্ত আমি। একটু ছায়া দিবি আমাকে? '

এসব একান্ত কিছু যে জানা ছিল আমার।প্রথম যেদিন বিতর্ক আর আবৃত্তি দিয়ে কাঁপিয়েছিল কলেজ অডিটরিয়াম- পাশে ছিলাম, প্রথম যেদিন গাঁজা খেয়ে চিৎকার করেছিল- ’নষ্ট হয়ে গেলাম!’ .. পাশে ছিলাম । প্রথম যেদিন একটু ছুঁয়ে দেখতে চেয়েছিল প্রতীতিকে, সেই নিজস্ব দিনেও তো পাশে ছিলাম।

আর আজ প্রথম যখন লাশ হয়ে গেলো, প্রথম যখন প্রবেশ করবে অনন্ত অন্ধকারে, তখন কি পাশে থাকবো না আমি?
আমার যে ভীষণ জানতে ইচ্ছে করছে ওই আত্নঘাতী কষ্টের স্বরূপ। নাকি এ কষ্ট অচেনা ছিল তার নিজের কাছেই? ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে সব দেখি। লাশটাকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে গোসল দিতে। অন্তর্গত রক্তে আমার বিপন্ন ক্লান্তি। ঘুমোতে ইচ্ছে করে। ভীষণ। অনন্ত নিদ্রা। তন্দ্রার ভেতর আমাকে হাতছানি দেয় ২১টা সোনেরিল।


[ সম্ভবতঃ ১৯৯৬ এর কোন একদিন লেখা]

Saturday, July 22, 2006

শূন্যকড়চা

'দ্যাজ ইট্‌ । তোর কোন প্রব্লেম নেই আসলে '
যেনো রায় ঘোষনা করলো অরুনা ।
মেয়েটা আজকাল চশমা পড়ছে । আমি চোখ তুলে ওর চোখে চোখ রাখতে চাইলাম।
না! কেবল দৃষ্টি বিনিময়। ওর দৃষ্টিতে সবকিছু বোঝে ফেলার এক প্রবল আত্নবিশ্বাস।

আমি ঠোঁটের কোনে সেই বাঁকা হাসিটা ফোটাতে চাইলাম । বছর কয়েক আগে এই হাসি বিভ্রান্ত করতো কাউকে কাউকে। অরুনা কি ছিল তাদের একজন?
আমি একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লাম । রিলাক্স মুডে ।
'আমার তাহলে কোনো প্রব্লেম নেই । দ্যাজ গুড-'
--' নো, দ্যাজ নো গুড । দ্যাজ দ্যা রিয়েল প্রব্লেম ইনফ্যাক্ট। ডাক্তার বলছে তুই ম্যান্টালি,ফিসিক্যালি একদম ফিট । বাট ইচ্ছে করে কিছু সমস্যা তৈরি করছিস । ভয়াবহ সব সমস্যা । কিন্তু তুই পাগল ও না, ড্রাগ এডিক্ট ও না'
অরুনার কপালে ভাঁজ । আমি ফ্রেঞ্চ ফ্রাই এ সস্‌ মাখাই।
বাইরে মৃত আলো । শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত রেঁস্তোরায় গুমোট সময়।
ওর হাত আমার হাত স্পর্শ করে। বন্ধুর হাত । একসময় পালকের মতো প্রীতিময় ছিলো । আজ কেনো জানি বেশ ভারী মনে হয়।
--' তোর মতো ছেলের এসব পাগলামী মানায়না । যা হবার হয়ে গেছে । ইউ হেভ টু রিভাইভ । খালাম্মা ভীষন কষ্ট পাচ্ছেন'
মেয়েটাকে এবার আমার অসহ্য লাগে ।

এই মেয়েটা, আমি-আমরা ক'জন বিশ্ববিদ্যালয়ের বছর গুলোতে বুনো হাঁসের পালকের মতো সন্নিহিত ছিলাম । হায় পাখী উড়ে যায় ! ছায়া যায়! এক সময় পড়ে থাকা পালক ও হারিয়ে যায় ।
অরুনা ইংল্যান্ড গিয়েছিল এম,বি,এ করতে । ফিরে এসে মাষ্টারি করছে একটা বেসরকারি(বেদরকারি!) বিশ্ববিদ্যালয়ে।
মাঝে মাঝে তবু শরীর ফিরে আসে । সময় ফেরেনা কখনোই।
তবু বহুদিন পর আমি আর অরুনা আবার।
--' আমি লন্ডন থেকে ব্যাক করার আগে চৈতির বাসায় গিয়েছিলাম । জানিস তো মনে হয় ওর একটা ছেলে হয়েছে।
কি ভীষন কিউট একটা ছেলে '
মেয়েটা আমাকে স্মৃতিতে ফিরিয়ে নিতে চাচ্ছে । বেশ চালাক হয়ে গেছে দেখছি।
--' আচ্ছা চৈতির সাথে তোর সমস্যাটা কি হয়েছিল বলতো? এতো বছর প্রেম করে বিয়ে করলি অথচ বছর পেরোবার আগেই
সেপারেশন! ও তবু আবার বিয়ে করলো, লন্ডন গেলো আর তুই? চাকরী বাকরী সব ছেড়ে দিলি । আমি ওকে ও জিজ্ঞেস
করেছিলাম। কিচ্ছু বললোনা । আর তুই তো আমার একটা মেইলের ও রিপ্লাই দিলিনা'
আমি মুরগির ভাজা ঠ্যাং এ কামড় দেই।
অরুনা আমার হাতে চিমটি কাটে
--'কিরে কথা বলিস্ না কেনো?'

আমার ইচ্ছে করেনা । না অরুনা, না অন্য কারো সাথে । আমার যত শব্দ বুনন এখন কেবলি নিজের সাথে।
'চৈতির সাথে সত্যি কি কোনো সমস্যা হয়েছিলো আমার? ও তো ভীষন ভালো একটা মেয়ে । বিছানায় এবং ভালোবাসায় । তবু কেনো যে একদিন আমার মনে হলো-- এই তবে ঘর সংসার,বিয়ে ভালোবাসা! কেমন একঘেঁয়ে অর্থহীন সম্পর্কের জটিলতা । অপ্রয়োজনীয় সন্তান উৎপাদন। পৃথিবীর প্রতিটি নারী-পুরুষ তো আর কবিতা লেখেনা,মাঝরাতে বাঁধ ভেংগে গেলে সবাই তো আর প্রতিরোধে আসেনা, প্রত্যেকে তো আর ভালোবেসে জল ঢালেনা বৃক্ষের শিকড়ে । তাহলে প্রতিটি নারী-পুরুষের কি প্রয়োজন জনক জননী হবার?'

আমার নৈঃশব্দে অরুনা বিরক্ত হয় । অরুনা বেদনার্ত হয় আমার জন্য । অরুনা উপহাস করে আমাকে
--'তুই যদি সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকিস কারো সাথে কিছু শেয়ার করবিনা, এ রকম মৌন হয়ে থাকবি তাহলে পাহাড় জংগলে চলে যা । গৌতম বুদ্ধ হয়ে বসে বসে ধ্যান করগে, যা '

হা হা হা । আমার হাসি পায়। অরুনার বিরক্তিতে আমার ভীষন হাসি পায় । হাসতে হাসতে আমি আমার নৈঃশব্দের ভাষায় ওকে বলি-
' অরুনারে কতো বুদ্ধ, কতো মুহম্মদ, কতো যীশু এলেন গেলেন । সমুহ বিপন্নতা থেকে তবু মানুষের পরিত্রান হলো কই? কতো দর্শন,কতো ধর্ম,কতো তন্ত্র তবু হত্যা,তবু ধবংস তবু হাহাকার'

রেঁস্তোরা ফাঁকা ছিলো এতক্ষন । হইহই করে এসে ঢোকলো একদল রংগিন ছেলে মেয়ে । ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসলো অনেকটুকু জায়গা নিয়ে । এরা বেঁচে আছে এখনো । আছে অর্থহিন বন্ধুতা ও ভালোবাসায় । আছে ক্লান্তিকর প্রেমে ও যৌনতায়।

আমি তবু ঝরাপাতার কান্না শুনি । যেনো হাঁটছি এক প্রান্তহীন শালবনের ভেতর দিয়ে। চরাচরে গভীর শুন্যতা । প্রান্ত্র জুড়ে অগনন ঝরা পাতা । ঝরছে আরো অবিরাম। আমি ইতঃস্তত হাঁটছি । পায়ের নীচে পাতা ভাংগছে।
স্মৃতি কাঁদছে। আমি ভাবলেশহীন।
কফির ধোঁয়া উড়ছে।

মুখোমুখি গন্তব্যহীন আমি ও অরুনা ।

Saturday, July 08, 2006

সে আর ফেরেনা

।।১।।
আজ সারাদিন এইভাবে কাটলো।

মেঘময়ুরী আকাশ।

কাল সারারাত বৃষ্টি হয়েছে।বাতাসে এখনো ভেজা ঘ্রান।
বুক ভরে নিঃশ্বাস নেয় হাসান। বুকের ভেতরটা ভিজে উঠে।অনুমান করে দূর পাহাড় অঞ্চলে বৃষ্টি হচ্ছে।ঘর ছেড়ে বারান্দায় এসে দাড়ায় সে।পাড়ার মসজিদ থেকে ভেসে আসে আছরের আজান।মুয়াজ্জিনের কন্ঠে কেমন বিষন্ন ক্লান্তি।সন্ধ্যা ঘনাতে আরো ঘন্টা দু'য়েক।
এতটা সময় সে কি করে কাটায়?

নাটক পাড়ায় যেতে আজকাল আর ভাল্লাগেনা।বিজ্ঞাপন মেলেনা বলে নাটক নামেনা আর মঞ্চে।রিহার্সেলের বদলে ছেলেরা এখন ক্রিকেট খেলে।পুরনো নাটুকেরা এখনো আঁতলামো করে--কা কা , কাকের মতো।অবশ্য ওই পাড়ায় গেলে এখনো মেয়ে দেখা যায়।গাড়ি চড়ে আসে তারা।তারা সংস্কৃতি করে।তারা আরো কতোকিছু করে।তারা যখন ফিরে যায় গাড়ি, রাস্তায় তখন নামতে শুরু করে সস্তা রঙ চং মাখা ক্রয়যোগ্য রমনীগন।ঈ সব রমনীগ্নের কেউ কেউ শিল্পকন্যা গনের গমন পথে তাকিয়ে মুচকি হাসে। কে যে কাকে চিনে নেয়, কে জানে?

এসব ভাবতে ভাবতে হাসানের নিকোটিনের তৃষ্ণা পায়। এমনিতে ও চেইন স্মোকার না।আসলে কোনো কিছুতেই কেনো জানি ওর নেশা হলোনা কোনোদিন। না ধোঁয়া,না সূরা,না নারী। তবু এসব কিছুতেই ওর নিজস্ব পছন্দ আছে।ধোঁয়ায় বেনসন, সূরায় স্কচ আর নারীতে মধুবালা!
গলির মাথার খুপড়ি দোকান থেকে বেন্সন জ্বালিয়ে আলতো করে টান দেয় সে।কিন্তু এখন যাবে কোথায়? আশ্চর্য কোথাও যাবার মতো একটা জায়গা নেই এই শহরে! অথচ শহরটা বিশ্রী রকম বাড়ছে সাইজে। ভিতরে ভিতরে এক অবোধ অস্থিরতা।
অবশ্য হাসান জানে এই সীমানাটা পেরোতে পারলেই দিকছোঁয়া আবহে নীলপাহাড়ের হাতছানি।সবুজ সন্ন্যাসের মোহক নির্জনতা। অইখানে রঙ্গীন ফুল আর প্রজাপতি আছে,পাখীদের কাকলি আছে,বুনো গন্ধমাখা গা শিরশির অনভূতি আছে।তবু এই তাপ্পিমারা,ধূলিধূসর,জ্যাম-জটের অসুস্থ শহরটাই যেনো তার সর্বশেষ নিয়তি।চুড়ান্ত চারনভূমি। এর বাইরে আর কখনোই নয়। আজকাল প্রায়ই নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে। এই জীর্ন শহরটা কি এক অন্ধ আক্রোশে তার কন্ঠনালী চেপে ধরে। তখন বাতাসে নীল পাহাড়ের ঘ্রান। হাসান শূন্যে হাত-পা ছুঁড়ে। কিছুটা সুস্থতা চায় সে, স্বাভাবিক হতে চায়। কিন্তু এই ঘূর্নীর যে কোনো শেষ নেই। চারদিকে মাথা উচুঁ করে আছে পাষান দেয়াল, নিস্ক্রমন সম্ভবের অতীত।
-এসব অতিক্রম করতে চাইলে সে জানে একদিন নিজের কন্ঠনালী নিজেই চেপে ধরতে হবে,কিন্তু সেই সাহসের ইচ্ছে হ্য়না কেনো জানি। ছিটকে সরে যাওয়ার শক্তিটুকু ও নষ্ট হয়ে গেছে কোনো এক দূর্বিপাকের দিনে।

তবু মাঝে মাঝে স্বপ্নের ঘোরে ভেবে নেয় সে--হয়তো কোনো একদিন,কোনো এক করমচা রোদ্দুর দিনে, কোনো এক বিদর্ভ নগরে...............
বেন্সনের হাল্কা ধোঁয়ার আবহে সেমেটিক মিথের মতো এক পলকের রহস্য ছড়িয়ে ছুটে যায় একটা রিক্সা। রিক্সায় বসা ছিল অরু। হাসলে যার ডান গালে টোল পড়ে। চোখে যার জড়িয়ে থাকে ঘুম ঘুম নেশা।
'অরু- তোমার কাছে আর যাওয়া হলোনা' -ভাবে হাসান । হয়তো একদিনে তার গোপন ইচ্ছে ই-মেইলের মতো দ্রুত পৌঁছে যাবে অরুর স্বপ্নে।

-----আমি অরু ।
----অরুনিমা সান্যাল বুঝি? 'মনে পড়ে কবেকার অরুনিমা সান্যালের মুখ'
হেসে উঠে অরু । আহা যেন আমার হাতের ছোঁয়ার মাঝে রংধনু।
-----'ওঁহু । আমি অরু। শুধুই অরু। আপনি?'
-----'আমি হাসান । হাসান আরিফ । জানেন এই নামটা আমার একেবারেই পছন্দের না । যদি ব্দলে ফেলা যেতো তবে '
-----'তবে?'
-----'তবে আমি আমার নাম ব্দলে রাখতাম ফিদেইল জীব্রান । ফিদেইল ক্যাস্ট্রো আমার কাছে জীবন্ত সাহস আর জীব্রান
আমার প্রফেট'
-----'আপনি ত লিখেন?'
-----'আপনি তো তানপুরা বাজান? আপনাদের নেক্সট প্রোগ্রাম কবে যেনো?'
---- ' এইতো মার্চের তিন'

হাসান নিঃশ্বাস নেয়।
----' মার্চের তিন আমি পঁচিশে পা দেবো গো মেয়ে । মার্চের তিন আমি তোমাকে ছিনিয়ে নেবো '
কথা বলার ফাঁকে আয়নায় নিজেকে দেখার মতো করে অরুকে দেখে নেয় হাসান। ঢেউ তোলা একরাশ চুল নেমেছে কোমর পর্যন্ত। কপালে সবুজ টিপ । কলাপাতা রঙ শাড়ি। ম্যাচ করা আটসাঁট ব্লাউজ। ভেতরে দুধসাদা ব্রা'র টানটান বেষ্টনী । মনে হয় তার ,এই বেষ্টনীর আড়ালে জেগে উঠা অবোধ রহস্য--কেউ এখনো স্পর্শ করেনি।
---'আমি তোমার কাছে যাবো অরু । একদিন খুব নির্জন আর ব্যাক্তিগত সময়ে । তখনো আর কেউ যায়নি তোমার
কাছে । তুমি আমার জন্য প্রতিক্ষায় থেকো ।'



।।২।।

এপয়েন্টমেন্ট লেটারটা হাতে পেয়ে বিমুঢ় হয়ে যায় হাসান ।
বিস্ময়ে , আনন্দে ।...শেষ পর্যন্ত হচ্ছে তাহলে!
এই শহর সে ছেড়ে যেতে পারছে । সে জানে এই শহর ক্রমশঃ আরো ভয়ংকর হয়ে উঠবে । এখন ই এই শহরে জ্যান্ত মানুষ পোড়ানো হয়, রাজপথে খুলে নেয়া হয় মেয়েদের শাড়ি । অচিরেই মায়েরা ধর্ষিতা হবে সুপুত্রদের দ্বারা, ষোড়শী সুন্দরীদের মাংস বিক্রী হবে কেজি দরে । হাসান জানে, হাসান জেনে গেছে এই মৃত শহরের ভবিষ্যত । যে মরে গেছে , দুর্গন্ধ ছড়ানোই তার পরিনতি, আর কিছু নয় ।
হাতে ধরা কাগজটাকে সে চুমু খায় , যেন প্রেমিকার ঠোঁট । এই কাগজ তার সামনে খুলে দিয়েছে এক অমৃত সম্ভাবনা ।

...হাসান যাচ্ছে বিলাসপুর ।
শহর থেকে অনেক দূরে ছোট্র আদিবাসী গ্রাম । আঁকাবাঁকা লাল্ মাটির পথ । আর একটা চমৎকার হ্রদ । হ্রদের জল স্বপ্নের মতো নীল । ঘুম ঘুম চোখে আদিবাসী শিশুরা আসবে স্কুলে । ওদের চোখ এখনো আকাশের মতো সজীব । গাদাগাদা বই আর কম্পিউটার গেমসের অভিশাপে মরে যায়নি ওরা ।
হাসান ওদের বর্নমালা শেখাবে । জানাবে রক্তাক্ত বর্নমালার ইতিহাস । টারবোম্যান,সুপারম্যানের ফ্যান্টাসী নয়, হাসান ওদের বলবে আসল নায়কের গল্প । জগতজ্যোতি নামের এক কিশোর যোদ্ধা কি করে একা একা যুদ্ধ করেছিল হানাদারদের বিরুদ্ধে অথবা শহীদ সোলায়মান--চলন্ত জীপের পেছনে যাকে বেঁধে টেনে নিয়েছিল ঘাতকেরা তবু সে সহযোদ্ধাদের ঠিকানা বলে দেয়নি ।
বেশ আগে একদিন ও একা একা বিলাসপুর ঘুরে এসেছিল । তখন দেখেছে ওখানে ময়ুর পেখমের মতো সব পর্দা উঠে যাছে । মাটির দিকে ঝুঁকে যাচ্ছে গভীর নীল আকাশের চুম্বন । খুলে যাচ্ছে কোন এক গভীর গোপন পবিত্র উৎসব রাত্রির সুখ- যেনো একটু পর শুরু হবে ঘুরে ঘুরে গোল নাচের মৃদু ও নম্র আসর ।
হ্রদের কিনারে একা খাড়া উচুঁ এক টিলা । টিলার উপর ছোট্র বাংলো । বাংলোর টিনের চালা হ্রদের জলের মতোই নীল।
বারান্দায় পা ঝুলিয়ে বসলে হ্রদের জল আর শূন্যতা ছাড়া কিছুই থাকেনা । এটাই হবে হাসানের নিজস্ব আবাস । চার দিকে ছড়িয়ে থাকবে জলতরংগের টুংটাং আর আয়ুহীন বিস্ময় ।
আর এসবের মাঝখানে এসে অরু বসবে , কালাতীত সময় ব্যাপে বিমুর্ত ভংগীমায় । তার মাথার উপর নীল আকাশ, পায়ের নীচে নীল জল আর পরনে নীল শাড়ী । কোলের উপর তানপুরা । কোন এক ঘুম ভাংগা রাত্তিরে প্রান পাবে এই ছবি । নারী তার চোখ বোঁজে কনকচাঁপা আংগুল ছোয়াবে তানপুরার তারে, নিঃসীম ঘুমকাতর পৃথিবীতে নামবে অলৌকিক সুরের বৃষ্টি ।

হাসান বড় সন্তর্পন প্রতীক্ষায় দিক কাটায় ।

ভোর রাতের দিকে ঘুম ভেংগে যায় জলতেষ্টায় ।
তারিখটা কত আজ? আঠার নাকি উনিশ? আঠার হলে আরেকটা চাকরীর ইন্টারভিউ ।
একটা N.G.O তে । ডিগ্রী পাশের কলা পাতাটা চিবিয়ে চৌদ্দ ঘন্টার দাসত্ব । মাস শেষে সাড়ে চার । তাও একটা পোষ্টের জন্য আল্লাহ্'র আরশ পর্যন্ত লম্বা লাইন । শালার দেশে একটা মড়ক লেগে মরতে পারেনা দু'চার কোটি? অথবা সব পুরুষেরা হ্যে যাক নপুংশক । পেটে ভাত নেই তবু এতো উৎপাদন!

এই আঁধোছায়া ভোরে মনটা বিষিয়ে উঠে হাসানের ।
তার থেকে তো এই ভালো কোনো এক অচেনা অরু আর অজানা বিলাসপুরের স্বপ্ন দেখা ।

দুরের মসজিদে ভোরের আজান ।
হাসান পাশ ফিরে আবার স্বপ্নে ডোবতে চায় ।
এই সময়ের স্বপ্ন নাকি সত্যি হয় !

[ কবে লিখেছিলাম? ২০০১ নাকি ২০০২ নাকি আরো আগে? ]


Monday, June 26, 2006

তীর্থ,ত্রিমাত্রিক


আমি যেতে চাইনি।
আমি যেতে চেয়েছি।
আমি গিয়েছি......
পরিনতিটাই তো চুড়ান্ত সত্য । যা ঘটল শেষ পর্যন্ত।
'হতে পারতো' 'হওয়ার কথা ছিল' এসব তো ব্যবহৃত টিস্যু পেপারের মতো ফাঁপা নিঃশ্বাস।
কতো কথা,কতো কথা দেয়া।আরো কতো কথা নেয়া।

তারপর...?
জীবন দাস কবি । থাকে শুধু অন্ধকার।
যে বৃক্ষের নীচে পাঁজর বদলে নিতাম পরস্পর,তার ডালপালা এখন ক্রমশ মৃয়মান। মাঝে মাঝে নিজেকে শকুনের মতো মনে হয় । একে একে সবাই পাড়ি জমাচ্ছে পাউন্ড ডলারের বেহেশতে।আমি একা এক হরিদাস পাল আটকে আছি এই মৃত ভাগাড়ে।

সেদিন চামেলীকে দেখলাম।মেয়ে নেই আর।মাশাল্লাহ মহিলা হয়ে গেছে গায়ে গতরে।সোনাদানা গায়ে লেপ্টে রিক্সার ঘোমটা তুলে যাচ্ছে কোথাও ।পাশে এক মাঝ বয়সী মধ্য শ্রেনীর লোক।ওর স্বামী নিশ্চয়।চামেলীর বিয়েতে আমরা গিয়েছিলাম।কিন্তু লোকটার চেহারা মনে নেই। আচ্ছা বিয়ের পরে লোকজন বউ নিয়ে ঘোরতে বেড়োলে রিক্সার ঘোমটা তুলে কেনো? বিবাহিত জীবনের অশ্লীলতা গুলো আরো আড়াল করার জন্য?
এই চামেলীকে তুমি ভয়াবহ সতর্ক করে দিয়েছিলে যেনো আমার কাছ না ঘেঁষে।এই নিয়ে ক্লাশে কতো হাংগামা!
আর সেই প্রথম জানলাম চামেলী আমার কাছ ঘেঁষতে চেয়েছিল,সেই প্রথম জানলাম তুমি আমাকে ভালোবাসো?
সেই তুমি এখন?----ব্যবহৃত টিস্যু পেপারের মতো ফাঁপা নিঃশ্বাস।

আর আমি তখন ভূগছি গোপন অসুখে।বোধের এবং মননের।
ক্লাশের শেষ ডেস্কে বসে টু ফাইভ সিগ্রেটের ফাঁপা শরীরে ঢুকাই মোহিনী গুঁড়ো।টান দিয়ে বন্ধুরা দেখে ড্রেস করা মাংসের পেকেট আর আমি ধরি বাতাস থেকে মোহময় শব্দ গুচ্ছ। শব্দ দিয়ে বাক্য গাঁথিঃ
'নোংগর তুলে নিলে নরোম মাটির বুকে থেকে যায় দাগ
মাটি না নোংগর,কার বুকে জন্মায় এতো অনুরাগ?'
আমি আমার বুকে এই দগদগে দাগ টের পেলাম,যাদিন নোংগর উঠে গেল বুক থেকে তুমুল আনুষ্ঠানিক্তায়।
এর আগে টের পাইনি আমি।
একদিন ও না!

কেননা এর আগেই ভেংগে পড়েছে বার্লিনের দেয়াল,মহামতি লেনিনের তর্জনী ভূপাতিত,সমাজতন্ত্রীদের যৌনক্রিয়ায় ব্যাপক তৃপ্তি দিচ্ছে ইউনাইটেড স্টেট অফ ভয়ংকর আমেরিকার কার্যকর ভায়েগ্রা।
আর তারো আগে প্রথম কৈশোরেই কি করে যেন আমার জানা হয়ে গিয়েছিল--সাম্যবাদ আর পুঁজিবাদের মধ্যে যুদ্ধ যদি বন্ধ হয়ে যায়, যদি ভালোবাসা আর ঘৃনার ভিন্ন মানে না থাকে--তাহলে মানুষ আর বসত গড়বেনা মানুষের বুকে।তখন পুরুষেরা জীবিকার নামে দাস হবে পুজিঁর আর নারীরা বিবাহের নামে হবে যৌনদাসী।
আর মানুষ ইতিহাসের পরিনতি বলেই, লেনিন ভেংগে পড়লে এক হরিদাস পাল কবির প্রেমিকাকে বিয়ে করে নিয়ে যায় বিদেশী বনিক।
পরিনতি জানা তবু তার প্রতিক্রিয়া এত তীব্র হলো কেনো?

ভালোবাসার উষ্ণ দিন গুলোতে যে তুমি আসোনি আমার শব্দে কিংবা বাক্যে,বিরহের শীতলতায় সে তোমার কেনো এত তীব্র উপস্থিতি? আর একি বিরহ? প্রত্যাবর্তনের সম্ভাবনাহীন প্রস্থান কি কোনো অর্থ বহন করে? এই অনর্থ যদি বিরাট অর্থবহ হয়ে দাঁড়ায়,তবে তার কোনো মানে হয়?

-----'জোছনার অন্ধকারে আমি এক অন্ধ তীরন্দাজ'
জোছনার অন্ধকার মানে কি? অন্ধ হলে তীরন্দাজ হ্য় কি করে?
এই সব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে খুঁজতে সুমনা যখন আমার খুব বুক ঘেষে আর আমারো রক্তে জাগছে শিকারের নেশা,তখন তুমি কেন প্রশ্নবোধক চিহ্ন হয়ে হ্যমারিং শুরু করেছিলে?কি মানে ছিলো আমার এই স্বপীড়নের,যখন তুমি ওম বিলাচ্ছো অন্য বিছানায়?
প্রতিটি পুরুষের কিছু নিজস্ব গোপন আনন্দ থাকে।মধ্যরাতের নির্ঘুম ফ্যান্টাসীতে সুমনা,তানিয়া অথবা রাস্তায় দেখা আটোসাঁটো জামার অচেনা মেয়েটা।
আমি প্রবল ভাবে চাই,তোমাকে চাই আমার নিরাভরন কল্পনায়। হৃদয়বান পুরুষের স্বর্গ তো ওখানেই। ওই স্বর্গে তোমার সাথে মিলিত হয়ে,তোমাকে ক্ষমা করে আমি বেঁচে উঠি।
সত্যি আমার তাই মনে হয়।
তুমি নেই অথচ তোমার উপস্থিতি আমাকে প্রবল ভোগায়।
আমার জরুরী হয়ে উঠে নিজের কাছে প্রমান করা যে তুমি তেমন বিশেষ কেউ নয়।
কিন্তু কি আশ্চর্য আমি আমার কল্পনায় ও বন্দী তোমার কাছে। যুক্তি ও বোধের এই প্রবল বৈপরীত্য আমাকে ক্রমশঃ অসহায়, বিরক্ত ও ক্রুদ্ধ করে তুলছিল।
তোমার কাছ থেকে মুক্তি পাওয়াটা খুব জরুরী হয়ে পড়েছিল।

আর তাই...
আমি গিয়েছিলাম।
তার কাছে।তাদের একজনের কাছে।হাজার বছর ধরে যারা পুরুষের নিরুপায় অশ্লীলতাকে বরন করেছে পুঁজির মূল্যে।
মেয়েটা খুব উষ্ণ ছিল।মেয়েটা খুব কৌশলী ছিল। সে আমার সবটুকু নিংড়ে নিয়েছিল। সে আমার প্রথম ছিল।
আর সে আমাকে মুক্তি দিয়েছিল অর্থহীন আবেগ আর নিস্ফল ভালোবাসা ফাঁদ থেকে।

এখন রোজ রাতে অন্য সবার মতো তুমি ও উষ্ণতা বিলাও আমার বিলাসী অশ্লীলতায়।
ভোক্তার কাছে সকল পন্য ই যেমন ভোগ্য, মুক্তবাজারে সকল দাস-দাসী ও তাই।
তুমি এবং আমি ।।

[ কবেকার লেখা? ২০০৩ হতে পারে...]

Saturday, June 24, 2006

গুল্ম ও কুঠার

[এসব ভাবনা তোমাকেই ভেবে, প্রিয় সতেরো সেপ্টেম্বর]

খেলাটা আমি প্রথম শিখেছিলাম হাসানের কাছে ।

সেদিন আমার বিশেষ কোনো কাজ ছিলনা । তেমন থাকেনা কখনোই । ভর দুপরে হাজির হয়েছিলাম ওর অফিসে ।
ও বেশ আগ্রহ নিয়ে আমাকে বলেছিল --'একটা জিনিস দেখবি ?'
---দ্যখা । আমার আসলে আগ্রহ ছিলনা তেমন ।
তবু ওর কথামতো চোখ রেখেছিলাম কম্পিউটার স্ক্রীনে । তেমন কিছুনা । কটা আবছায়া রেখা শুধু ।
---'রেখাগুলোর মাঝখানে চারটা বিন্দু দেখছিস? ওখানে চোখ রাখ । একেবারে ৩০ সেকেন্ড । একটু ও নড়বিনা ।
চোখের পলক ফেলবি না । '
আমি তাই করলাম ।
---'এবার চোখ বন্ধ কর । ঘাড়টা একটু পেছনে হেলিয়ে দে '
আমি ওর নির্দেশ শুনি ।

প্রথমে অন্ধকার । প্রিয় অন্ধকার । একটু ফিকে ক্রমশঃ ।
একটা গোলাপী বলয় ।
তার ভেতরে কিযেন একটা । কে যেন এক!
একটা চেহারা । আসছে... যাচ্ছে... ভাসছে । ধরতে পারছিনা, পারছিনা । হঠাৎ.. স্থির ।
যেশাস! যীশুর মুখচ্ছবি । মানুষের সমস্ত পাপ ধারন করে যে ক্রুশ কাঠে বিদ্ধ করেছিল নিজেকে ।

সেদিন পরপর তিনবার কম্পিউটারে খেলাটা খেলেছি আমি । হাসান কম্পিউটারের লোক । ও কিসব লজিক টজিক দিয়ে খেলাটার একটা ব্যখ্যা দিয়েছিল আমাকে । বোঝিনি । সবকিছুর সব ব্যাখ্যা ভাল্লাগেনা আমার

সেদিন পুরোটাই যেন ছিল আমার জন্য শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ।
হাসানের শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত অফিস থেকে বেরিয়ে ফুটপাতে দাঁড়াতেই প্রতীতি ও তার চার চাকার মোটর যান । ওটা ও শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত। শালার দেশটা কি আইসল্যান্ড হয়ে যাচ্ছে নাকি ? নাকি মানুষের চর্বি জমছে বেশী, তাই গরম ও বেশী বেশী!
গাড়ীতে উঠার পর প্রতীতি জানালো ও আমাকে সকাল বেলা থেকে খুঁজছে । আজ আমার জন্ম দিন ।
আহ্‌ হা ! এই মাত্র মনে পড়ল । Happy Birthday to me!
ঘুম থেকে উঠে মনে পড়লে তো নিজের গালে নিজেই একটা চুমো দেবার চেষ্টা করতাম । যায় নাকি ওরকম? নিজের গালে নিজে চুমো ? আমি কারো গালে এখনো চুমো দেইনি । আমাকে ও কেঊনা । বলবো নাকি প্রতীতিকে?
থাক্‌- বেচারা হাসান মাইন্ড করবে । নারী আর নদী কেবলি ভাংগে । গড়ে ও । কিন্তু সেতো ভাংগনের পর প্রলেপ মাত্র ।

সেই দুপুরে, আমার জন্মদিনের দুপুরে প্রতীতি আমাকে খাইয়েছিল একটা শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত রেঁস্তোরায় ।
প্রতীতি আমার প্রেমিকা না।প্রতীতি কবিতা বোঝেনা।প্রতীতি প্রীতিলতাকে চেনেনা।প্রতীতি হিন্দী সিরিয়ালের পোকা।প্রতীতি আমার মাথাব্যথা।

একবার আমি কাউকে কিছু না জানিয়ে হারিয়ে গিয়েছিলাম কয়েকদিনের জন্য। আসলে আমি চলে গিয়েছিলাম শহর ছাড়িয়ে বেশ দুরের এক চা-বাগানে। আমার এক বন্ধু ছিল ওখানে। সেই চা-বাগানের ভেতর খ্রীস্টানদের একটা কবরস্থান । রাবার গাছ ঘেরা । কি ভীষন নির্জনতা ছিল সেখানে। টুপটাপ অক্সিজেন ঝ্রে পড়ার শব্দ শুনেছিলাম আমি । রাবার গাছের বিচিগুলো অদ্ভুত সুন্দর । যেন আল্পনা আঁকা । কার কথা ভেবে যেনে কটা নিয়ে এসেছিলাম পকেটে করে ।
শহরে ঢুকতেই প্রতীতির সাথে দেখা । আমি আমার সবটুকু উজাড় করে দিয়েছিলাম । ও গ্রহন করেছিল । হেসেছিল । হয়তো হাসিতে ভালবাসাই ছিল । কিন্তু আমি কেন যেন তাচ্ছিল্য দেখেছিলাম।

ওর বড় বেশি ভালোবাসা । শরীরে, মনে, সবকিছুতে । বালিকা বাস করে বায়ুমাঝে । বালিকা জানেনা ঘৃনা করতে না জানলে সত্যি করে ভালবাসা যায়না । যেমন চাঁদ তারাকে ঘৃনা না করলে ভালোবাসা যায়না লালসবুজকে । মধ্যপ্রাচ্যের মানচিত্রে ঘৃনা,কানকুনের বনিক সভায় ঘৃনা,ধর্ম গ্রন্থগুলোর পাতায় পাতায় ঘৃনা । প্রতীতি ওসবের খোঁজ রাখেনা ।

রেস্তোঁরায় মুখোমুখি বসে আমার চোখ পড়েছিল ওর রাজ হংসীর মত গলায় । ওখানে একটা চমৎকার তিল । ইচ্ছে হয়েছিল ওখানে চোখ রেখে ওই খেলাটা শুরু করি আবার ।প্রতীতি চোখ নামিয়েছিল কিন্তু আমার আর মনঃসংযোগ হয়নি।

সেদিন বাড়ি ফিরি আমি মাঝরাতে ।
দেয়াল টপকে ভেতর বাড়ি । শেওলা ধরা সিঁড়ি বেয়ে আমার দেড়তলার খুপড়িঘরে। নীচে বড়ভাইয়ের ঘরে বাতি নেভানো।নিষিদ্ধ শব্দমালা, ভালোবাসা অথবা ঘৃনার পদাবলী। পাশের ঘরে বাবার কাশির শব্দ । জীবনের দায়শোধ । জননী সে দায় শোধ করে চলে গেছেন আমাকে জন্ম দিতে গিয়ে ।

বহুদিন পর সেই রাতে আমার মনে পড়েছিল- এক সময় আমি ছবি আঁকতাম । পাখী,মাছ,ফুল,প্রজাপতি,ঘোমটা দেয়া বৌ। সবল মাঝি,ভালোবাসা । বিছানার নিচে তখনো ক্ষয়ে যাওয়া রংতুলি, শুকিয়ে যাওয়া রংয়ের কৌটা ।
শুকিয়ে যাওয়া রংযের কৌটায় জল ঢেলে ক্ষয়ে যাওয়া তুলি ভিজিয়ে আবছায়া কটা টান দিয়েছিলাম কোনার দেয়ালে ।
না পাখী,না মাছ,না ফুল,না প্রজাপতি,না ঘোমটা দেয়া বউ,না সবল মাঝি,না ভালোবাসা ।
আমি কেবল কটা টান দিয়েছিলাম ঘৃনার । আর তার ভেতর কটা বিপরীত ফোঁটা ছিল । ভালোবাসার ।
তারপর শুরু করেছিলাম সেই খেলাটা ।

ঘৃনার দাগের ভেতর ভালবাসার কটা ফোঁটা । সেগুলোতে চোখ রাখা একটানা । তারপর চোখ বন্ধ করে ঘাড়টা একটু পেছনে হেলে দেয়া । একটা আবছায়া গোলাপি বলয় । কিন্তু এবার আর যিশু নয় । ওখানে এক বালিকার মুখ । সেই বালিকা ফ্রেম বন্দী হয়ে আছে আমার বাবার সাথে বিয়ের ছবিতে ।

সেই রাত থেকে প্রতিরাতে এই খেলাটা খেলি আমি । সেই একই খেলা । মাঝে মাঝে মুখগুলো বদলায় শুধু ।
কখনো সে মুখ মার্গারেট ম্যাতিউস,কখনো প্যালেস্টাইনের কোনো অচেনা কিশোরী- যে বুকে বোমা বাঁধছে প্রবল ঘৃনায় তার তীব্র ভালোবাসাকে বাঁচাবে বলে ।
আমি ওখানে একটা মুখ দেখতে চাই । সে কারনেই আমার প্রতিরাতের আয়োজন ।
জানি একদিন সে মুখ আমি দেখবো নিশ্চিত । আর সেদিনই শেষ হয়ে যাবে আমার এ খেলা ।
আমার আশ্চর্য উদ্ধার । ।

[২০০২ এর কোন একদিন লেখা ]