Saturday, July 22, 2006

শূন্যকড়চা

'দ্যাজ ইট্‌ । তোর কোন প্রব্লেম নেই আসলে '
যেনো রায় ঘোষনা করলো অরুনা ।
মেয়েটা আজকাল চশমা পড়ছে । আমি চোখ তুলে ওর চোখে চোখ রাখতে চাইলাম।
না! কেবল দৃষ্টি বিনিময়। ওর দৃষ্টিতে সবকিছু বোঝে ফেলার এক প্রবল আত্নবিশ্বাস।

আমি ঠোঁটের কোনে সেই বাঁকা হাসিটা ফোটাতে চাইলাম । বছর কয়েক আগে এই হাসি বিভ্রান্ত করতো কাউকে কাউকে। অরুনা কি ছিল তাদের একজন?
আমি একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লাম । রিলাক্স মুডে ।
'আমার তাহলে কোনো প্রব্লেম নেই । দ্যাজ গুড-'
--' নো, দ্যাজ নো গুড । দ্যাজ দ্যা রিয়েল প্রব্লেম ইনফ্যাক্ট। ডাক্তার বলছে তুই ম্যান্টালি,ফিসিক্যালি একদম ফিট । বাট ইচ্ছে করে কিছু সমস্যা তৈরি করছিস । ভয়াবহ সব সমস্যা । কিন্তু তুই পাগল ও না, ড্রাগ এডিক্ট ও না'
অরুনার কপালে ভাঁজ । আমি ফ্রেঞ্চ ফ্রাই এ সস্‌ মাখাই।
বাইরে মৃত আলো । শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত রেঁস্তোরায় গুমোট সময়।
ওর হাত আমার হাত স্পর্শ করে। বন্ধুর হাত । একসময় পালকের মতো প্রীতিময় ছিলো । আজ কেনো জানি বেশ ভারী মনে হয়।
--' তোর মতো ছেলের এসব পাগলামী মানায়না । যা হবার হয়ে গেছে । ইউ হেভ টু রিভাইভ । খালাম্মা ভীষন কষ্ট পাচ্ছেন'
মেয়েটাকে এবার আমার অসহ্য লাগে ।

এই মেয়েটা, আমি-আমরা ক'জন বিশ্ববিদ্যালয়ের বছর গুলোতে বুনো হাঁসের পালকের মতো সন্নিহিত ছিলাম । হায় পাখী উড়ে যায় ! ছায়া যায়! এক সময় পড়ে থাকা পালক ও হারিয়ে যায় ।
অরুনা ইংল্যান্ড গিয়েছিল এম,বি,এ করতে । ফিরে এসে মাষ্টারি করছে একটা বেসরকারি(বেদরকারি!) বিশ্ববিদ্যালয়ে।
মাঝে মাঝে তবু শরীর ফিরে আসে । সময় ফেরেনা কখনোই।
তবু বহুদিন পর আমি আর অরুনা আবার।
--' আমি লন্ডন থেকে ব্যাক করার আগে চৈতির বাসায় গিয়েছিলাম । জানিস তো মনে হয় ওর একটা ছেলে হয়েছে।
কি ভীষন কিউট একটা ছেলে '
মেয়েটা আমাকে স্মৃতিতে ফিরিয়ে নিতে চাচ্ছে । বেশ চালাক হয়ে গেছে দেখছি।
--' আচ্ছা চৈতির সাথে তোর সমস্যাটা কি হয়েছিল বলতো? এতো বছর প্রেম করে বিয়ে করলি অথচ বছর পেরোবার আগেই
সেপারেশন! ও তবু আবার বিয়ে করলো, লন্ডন গেলো আর তুই? চাকরী বাকরী সব ছেড়ে দিলি । আমি ওকে ও জিজ্ঞেস
করেছিলাম। কিচ্ছু বললোনা । আর তুই তো আমার একটা মেইলের ও রিপ্লাই দিলিনা'
আমি মুরগির ভাজা ঠ্যাং এ কামড় দেই।
অরুনা আমার হাতে চিমটি কাটে
--'কিরে কথা বলিস্ না কেনো?'

আমার ইচ্ছে করেনা । না অরুনা, না অন্য কারো সাথে । আমার যত শব্দ বুনন এখন কেবলি নিজের সাথে।
'চৈতির সাথে সত্যি কি কোনো সমস্যা হয়েছিলো আমার? ও তো ভীষন ভালো একটা মেয়ে । বিছানায় এবং ভালোবাসায় । তবু কেনো যে একদিন আমার মনে হলো-- এই তবে ঘর সংসার,বিয়ে ভালোবাসা! কেমন একঘেঁয়ে অর্থহীন সম্পর্কের জটিলতা । অপ্রয়োজনীয় সন্তান উৎপাদন। পৃথিবীর প্রতিটি নারী-পুরুষ তো আর কবিতা লেখেনা,মাঝরাতে বাঁধ ভেংগে গেলে সবাই তো আর প্রতিরোধে আসেনা, প্রত্যেকে তো আর ভালোবেসে জল ঢালেনা বৃক্ষের শিকড়ে । তাহলে প্রতিটি নারী-পুরুষের কি প্রয়োজন জনক জননী হবার?'

আমার নৈঃশব্দে অরুনা বিরক্ত হয় । অরুনা বেদনার্ত হয় আমার জন্য । অরুনা উপহাস করে আমাকে
--'তুই যদি সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকিস কারো সাথে কিছু শেয়ার করবিনা, এ রকম মৌন হয়ে থাকবি তাহলে পাহাড় জংগলে চলে যা । গৌতম বুদ্ধ হয়ে বসে বসে ধ্যান করগে, যা '

হা হা হা । আমার হাসি পায়। অরুনার বিরক্তিতে আমার ভীষন হাসি পায় । হাসতে হাসতে আমি আমার নৈঃশব্দের ভাষায় ওকে বলি-
' অরুনারে কতো বুদ্ধ, কতো মুহম্মদ, কতো যীশু এলেন গেলেন । সমুহ বিপন্নতা থেকে তবু মানুষের পরিত্রান হলো কই? কতো দর্শন,কতো ধর্ম,কতো তন্ত্র তবু হত্যা,তবু ধবংস তবু হাহাকার'

রেঁস্তোরা ফাঁকা ছিলো এতক্ষন । হইহই করে এসে ঢোকলো একদল রংগিন ছেলে মেয়ে । ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসলো অনেকটুকু জায়গা নিয়ে । এরা বেঁচে আছে এখনো । আছে অর্থহিন বন্ধুতা ও ভালোবাসায় । আছে ক্লান্তিকর প্রেমে ও যৌনতায়।

আমি তবু ঝরাপাতার কান্না শুনি । যেনো হাঁটছি এক প্রান্তহীন শালবনের ভেতর দিয়ে। চরাচরে গভীর শুন্যতা । প্রান্ত্র জুড়ে অগনন ঝরা পাতা । ঝরছে আরো অবিরাম। আমি ইতঃস্তত হাঁটছি । পায়ের নীচে পাতা ভাংগছে।
স্মৃতি কাঁদছে। আমি ভাবলেশহীন।
কফির ধোঁয়া উড়ছে।

মুখোমুখি গন্তব্যহীন আমি ও অরুনা ।

No comments: