Monday, August 10, 2009

অন্তর্গত

কে কোথায় নিভে গেছে তার গুপ্ত কাহিনী জানি।
নিজের অন্তর দেখি, কবিতার কোন পঙতি আর
মনে নেই গোধূলিতে; ভালোবাসা অবশিষ্ট নেই।
অথবা গৃহের থেকে ভুলে বহির্গত কোনো শিশু
হারিয়ে গেছে পথে, জানেনা সে নিজের ঠিকানা
[সন্তপ্ত কুসুম ফোটেঃ বিনয় মজুমদার]


(উৎসর্গঃ- প্রিয় শিমুল, আনোয়ার সাদাত শিমুল'কে- যে একদিন বড় হয়ে, আরো বড় গল্পকার হবে)



১.
ঘুমের ভেতর অসুখের ঘ্রান পায় হাসান অথবা অসুখের ঘ্রানে ঘুম ভাঙ্গে। ঘুম ভাঙ্গে কিন্ত চোখ খুলতে পারেনা, চোখ খুলে তাকাতে পারেনা। যেনো চোখের ভেতরে মুঠো মুঠো বালি ঠেসে দেয়া। কড়কড়ে অস্বস্তি।
দু হাত উপরে চেপে ধরে ধীরে ধীরে খুলতে গিয়ে যেনো সে ঝলসে যায়, চোখের উপর হাজার ওয়াটের বাতি জ্বলছে। আঙ্গুলের ফাঁক দিয়ে দৃষ্টি গেঁথে যায় অনেক উঁচুতে জানালার গরাদে। গরাদ ঠেলে রোদ আসছে অথচ বাতাস নেই। ফুসফুসে হাসফাস।
এই কারাগার থেকে সহসা মুক্তি নেই, জেনে তবু কি এক অবোধ্য তাড়নায় সে লাফিয়ে উঠে গরাদ ভাঙবে বলে।
ঘোর। ঘোর কাটলে পরে হাসান টের পায় এটি তার ব্যক্তিগত শোবার ঘর মাত্র। গত রাতে বাতি নেভানো হয়নি। জানালার পর্দা ও টানা হয়নি। বেলা অনেক। বাইরের কড়া রোদ ঘরের ভেতর।

২.
বাচ্চাদের স্কুলের সকালের শিফট শেষ হবার আগে আগে রাস্তার উল্টোপাশে এসে দাঁড়ায় হাসান।
পাড়ার ময়লা নিয়ে যাচ্ছে একটা ভ্যান। ভ্যানের পেছন থেকে ময়লা গড়িয়ে পড়ছে রাস্তায়। মাইকে প্রবল চিৎকার। মানুষের অহেতুক ছুটোছুটি। স্কুলের গেটে এসে ভীড় করছে অভিভাবকরা। হাসানের কোন তাড়া নেই। অফিস ছুটি সপ্তাহখানেকের। কোথাও তেমন যাওয়ার নেই।
বাচ্চারা সব বের হয়ে আসার পর একজন দুজন করে মিস্ট্রেস ও বের হতে থাকে। একেবারে পেছনে চৈতী। হাসান রাস্তা পেরোয়। চৈতী হাত নাড়ে। কলাপাতা রংয়ের জামা, চুল বেনী করা- ওকে বালিকা বিদ্যালয়ের নবম শ্রেনী বলে ভ্রম হয়।
চোখমুখে রোদ ঝলমল আলো ফুটিয়ে ও এসে হাসানের বাহু স্পর্শ করে।-‘ চলো আইসক্রীম খাবো’
কিছুটা দূর হেঁটে ওরা আইস ক্রীম পার্লারে ঢুকে। ফালুদার গ্লাসে চুমুক দিতে দিতে চৈতী বলে- তোমার তো ছুটি, চলো কাল কোথাও বেড়াতে যাই সারাদিনের জন্য। আমি ছুটি নিতে পারবো।

আইস ক্রীম পার্লারের ঠান্ডায় হাসানের ঘুম পায়। থুতনীতে হাত ঠেকিয়ে বলে-কোথায় বেড়াতে যাবে? এই শহরে নিঃশ্বাস নেয়ার মতো কোন জায়গা খুঁজে পাইনা আমি

চৈতী জানায় শহরের ঠিক অদূরেই নাকি একটা বিনোদন পার্ক হয়েছে। পার্কের ভেতরে পাহাড় আছে। পাহাড়ের নির্জনতায় ছোট ছোট কুটির। চাইলে সারাদিনের জন্য ভাড়া নেয়া যায়। শহরের সব প্রেমিক প্রেমিকেরা নাকি পয়সা খরচ করে প্রেম করতে ভীড় করছে ঐসব ভাড়াটে কুটিরে।
হাসান হাসে- যাওয়া যায়, পুরো দিনের জন্য আমরা ও একটা কুটির ভাড়া নিতে পারি।তবে কাল না। অন্য দিন।
-কাল নয় কেন?
- কাল বিকেলে অথৈর ডাক্তারের এপয়েন্টমেন্ট আছে।
-ওহ!

তারপর ক’মুহুর্তে শীতাতপ যন্ত্রের একটানা আওয়াজ ছাড়া আর কোন শব্দ থাকেনা।হাসান টেবিলে আঁকিবুকি কাটে। চৈতীই ফের কথা বলে
-কি অবস্থা মেয়েটার?
-ভালো না। ডাক্তাররা কিছুই ধরতে পারছেনা। ডায়াগোনোসিস চলছে একটার পর একটা।কিন্তু
-ওর বাবা একটা অমানুষ
-ওঁহু। সবই পরিস্থিতি।
-একমাত্র মেয়ের এই অবস্থায় সে বিদেশে পড়ে থাকতে পারলো?
-সে বিদেশে আছে বলেই অন্ততঃ মেয়েটাকে বাঁচানোর চেষ্টা করা যাচ্ছে
-বাচ্চাটাকে ওর বাবা চিকিৎসার জন্য নিয়ে যেতে পারেনা?
-নাহ। ও নিজেই এখনো বৈধ হতে পারেনি।
-ও তোমার খুব ভালো বন্ধু ছিলো, তাইনা?

হাসান কথা বলেনা। বিরক্ত হয়। চৈতীকে আগে ও বলেছে, তবু কি এক অদ্ভূত কারনে এই প্রশ্ন সে বার বার করে। অথৈ’র বাবা ফয়সাল কখনোই ওর বন্ধু ছিলোনা। সহকর্মী মাত্র। হাসান যখন অফিসে জয়েন করে ফয়সাল তখন মাত্র ক’দিন হয় বিয়ে করেছে প্রেম করে। দু পরিবারেরই অসম্মতিতে।সে দুপুরের লাঞ্চ নিয়ে আসতো বাসা থেকে। হাসানকে জোর করে খাওয়াতো। একদিনের জন্য ও সে হাসানকে বাইরে লাঞ্চ করতে দেয়নি। বাসায় নিয়ে গেছে। ওর বৌ নীলার সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছে, নীলার তখন বাচ্চা হবে। বাচ্চা হবার সময় প্রচুর রক্তপাত হলো, কাকতালীয় ভাবে রক্তের গ্রুপ মিলে গেলো হাসানের সাথে। হাসান রক্ত দিলো। বছর খানেক পর অফিসের এক প্রোগ্রামে আমেরিকা গিয়ে যখন ফয়সাল আর ফিরলোনা নীলা তখন হাসানকেই জানালো এটা তাদের পুর্ব পরিকল্পিত, আর্থিক দৈন্যদশা মেটানোর নাকি আর কোন পথ ছিলোনা।
আরো ক’দিন পর যখন অথৈ মেয়েটা অসুস্থ হলো- নীলা হাসানকেই জানালো, , আমেরিকা থেকে ফয়সাল ফোন করে অনুরোধ করলো ওর মেয়েটাকে নিজের মেয়ের মতো করে দেখতে, ওদেরকে দেখার আর কেউ নেই।
বন্ধন ভাল্লাগেনা, তবু জড়ায়-হাসান তবু জড়াতে থাকে নানা বন্ধন ও বিমুগ্ধতায়।

চৈতী হাসানের চুলে হাত ছোঁয়ায়। বলে- ‘আমার কিন্তু ভালো লাগে, এই যে একটা বাচ্চার জন্য তোমার এতো কেয়ার।তুমি খুব ভালো বাবা হবে, আমার চিন্তা নেই’
হাসান হাসে-‘ কি জানি, আমার বরং লালন ফকিরকেই ভালো লাগে।বলেছিলেন- জন্ম দিওনা, জন্ম দিলে আত্না খন্ডিত হয়ে যায়।‘
-'হয়েছে। তুমি লালন না। তুমি হলে হাসান। আমার হাসান'

প্রায় নির্জন আইসক্রীম পার্লারে চৈতী আরো ঘন হয়ে আসে, ঘন হয়ে আসে ওর চুলের ঘ্রান।
হাতের আঙ্গুল নিয়ে আনমনে খেলতে খেলতে ও বলে- যাবে এখন আমার সাথে? মেয়েটাকে দেখে আসি। ওর মা একেবারে একা।
চৈতীর হাত ফিরে যায়।
যেতে যেতে বলে - 'আজ আমার কাজ আছে।অন্য কোন দিন যাবো। আজ তুমি একাই যাও'

তারপর আর তেমন কথা এগোয়না। সমস্ত সুঘ্রান নিয়ে মেয়েটা চলে যাওয়ার পর ‘একা’ শব্দটা বড় ভারী ও তপ্ত হয়ে উঠে হাসানের জন্য।হিমহিম আইস ক্রীম পার্লারে ফিরে আসে সকালের হাসফাস, অসুখের ঘ্রান।

ক’বছর আগে কলেজের বন্ধু এন্টনীর সাথে ও বেড়াতে গিয়েছিলো খাসিয়া পল্লীতে। এন্টনীর দাদী থুত্থুড়ে বুড়ি নাকি হাত দেখে ভবিষ্যত বলে। কৌতুহলে সে ও বসেছিল বুড়ির পাশে। হাত ধরে রেখে দীর্ঘক্ষন, ফিসফিসিয়ে বুড়ি বলেছিল-‘ তোর তো শরীর ভরা অসুখ রে ব্যাটা!’

শরীর ভরা অসুখ নিয়ে গ্লাসডোরে ঠেলে বেরিয়ে আসে হাসান।

৩.
বাইরে প্রবল রোদ। থকথকে মানুষের দল। দলবদ্ধ জটলা। অথৈদের বাসায় যাবার জন্য রিক্সা, টেক্সী কিচ্ছু নেই।অলংঘনীয় জ়্যামে আটকে আছে গোটা শহর। জ্যামে আটকে আর্তনাদ করছে একটা ফায়ার সার্ভিসের গাড়ী। একটানা হর্ণ বাজাচ্ছে। একচুল নড়ছেনা কেউ। হাসান রাস্তায় নেমে এসে হাঁটতে থাকে।

ফুটপাত বলে কিছু নাই। মানুষের শরীরের উপর দিয়ে গড়িয়ে হাঁটছে মানুষ। ছুটছে আরেকদল। আরেকদিক থেকে হর্ণ বাজাতে বাজাতে চলে গেলো পুলিশের গাড়ী। কেউ একজন চিৎকার করে বললো-শহরের প্রধান বিপণীতে আগুন লেগেছে। বেশ উঁচুতে আগুনের শিখা। অনে দূর থেকে তার হল্কা এসে ধাক্কা দিলো।

হাসানের শরীর জ্বলছে। কাল ফেরার আগে পিঠে নখের আঁচড় বসিয়ে দিয়েছিলো নীলা।সারা রাত জ্বলেছে, এখন জ্বলছে আবার ।
শহর জ্বলছে। শরীর ভর্তি আগুন নিয়ে হাসান দৌড়ায় এবার।

দৌড়ের ভেতর অসুখের ঘ্রান পায় হাসান অথবা অসুখের ঘ্রান নিয়েই দৌড়ায়। দৌড়ায় অথচ চোখ খুলতে পারেনা, চোখ খুলে তাকাতে পারেনা। যেনো চোখের ভেতরে মুঠো মুঠো বালি ঠেসে দেয়া। কড়কড়ে অস্বস্তি।