সাত শতাব্দী আগে সাতটি সাদা কবুতর গভীর উপত্যকা থেকে উড়ে গিয়েছিলো ওপরে বরফাস্তীর্ণ পাহাড় শিখরে; নীচে সাতজন মানুষের মধ্যে একজন ওই কবুতরগুলো দেখে বলেছিলো-'আমি সপ্তম কবুতরটির পাখায় একটি কালো বিন্দু দেখতে পাচ্ছি'। আর আজ ঐ উপত্যকার লোকজন,সেই যে সাতটি কবুতর উড়ে গিয়েছিলো শুভ্র বরফের পাহাড়ে সাত সাতটি শতাব্দী আগে-তাদেরই গল্পগাঁথা করে থাকে।
there's a bluebird in my heart that wants to get out
but I'm too clever, I only let him out at night sometimes
when everybody's asleep.
I say, I know that you're there, so don't be sad.
and we sleep together like that with our secret pact
and it's nice enough to make a man weep,
but I don't weep,
do you?
রিনি চলে যাবার পর সে আঁকিবুকি আঁকে কাগজে।
কলম চড়ে বেড়ায় ইতঃস্তত,উদ্দেশ্যহীন-তার মতোই। ক'টা দাগ আঁকা হয় যেমন খুশী।না কোন শব্দ, না কোন বাক্য- না কোন প্রয়োজন। কাগজ দলা পাকায়, দলা পাকানো কাগজ শুয়ে থাকে নিরীহ আয়োজনে।
নতুন কাগজ শরীর মেলে। এবার কিছু শব্দ, একটি বাক্য-আয়োজনহীন, লেখা হয়। 'কোন সভ্যতাই মুছে দিতে পারেনি মানুষের বিষন্নতা'
কথাটা তার নিজের নয়। মগজের গলি-ঘুপচিতে আটকে থাকা অগুনতি বানানো কথার একটি। কে বলেছিলো যেনো?
মনে পড়ে- ইউজেন ইউনেস্কো। টেকো মাথার ফরাসী লোকটা শৈশবে ঘৃনা করতো থিয়েটার। পাঁরির রাস্তায় পুতুল নাচ দেখে বড় হতে হতে কি করে সে হয়ে গেলো নাটুকে মানুষ?
সেদিন রিনি ছিলো পাশে। বিয়ারের বুদ্বুদ ছিলো। টিভি জুড়ে ছিলো চ্যানেলের অদল বদল। বদলাতে বদলাতে একটা বাংলা সিনেমা। স্টিল আলমিরার মতো চ্যাপ্টা একটা হোঁদল, চর্বি ও মেদসর্বস্ব কুৎকুৎএর উদ্দেশ্যে চিৎকার করছে- 'আমি তোমাকে ঘৃণা করি কারন ঘৃণা করতে ভালোবাসা লাগে। আমি তোমাকে ভালোবাসিইইইইই...'
সে হেসে উঠেছিলো হাহাহা। 'ঘৃনা করতে নাকি ভালোবাসা লাগে'-হো হো... ছলকে উঠেছিল বিয়ার। চমকে উঠেছিল রিনি। -এমন করে হাসে কেউ? তুমি আমাকে চমকে দিয়েছো।
-কমল এমন করে হাসেনা রিনি? তুমি চমকাও না আর?
-ধুর! ও এখন একটা ফার্নিচারের মতো। বোধহীন, প্রেমহীন।
-অথচ তুমি একসময় মরে গিয়েছিলে অজান্তে। বালিকা জানতোনা সে মরে গেছে।
-বোকা ছিলাম রে। অনেক বোকা।
-এখন অনেক চালাক হয়েছো রিনি? চালাকীতে কবিতা হয়না। তোমাকে দিয়ে কবিতা হবেনা বরং ফিরে যাও বাহারী ফার্নিচারের কাছে।
রিনি ফিরে গিয়েছিলো, রিনি ফিরে এসেছিলো। রিনি ফিরে যায়, রিনি ফিরে আসে। ফিরে এসে বারবার নত হয়, প্রার্থনার মতো নরোম অথচ লালসা'র পূর্নতায় ফিসফিস করে- 'আমাকে কবিতা দাও তুমি' - আমি তো কবিতা লিখিনা রিনি, লিখিনি কোনদিন।
রিনি তবু নাছোড়- 'আমি জানি, তুমিই কবিতা। বোধহীন, প্রেমহীন আসবাব আমার ভাল্লাগেনা, নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে। আমাকে কবিতা দাও, প্রান দাও তুমি-আমাকে স্পর্শ করো'
মেয়েটাকে তার কাছে সিনেমার সেই কুৎকুৎএর মতো লাগে। দেয়ালের আবছায়ায় নিজের মুখ খুঁজতে খুঁজতে সে বলে- 'তোমার স্পর্শে এখন আর পরিত্রান নেই রিনি, বরং তুমি এবার গদ্য লিখো। যুক্তিতে কবিতা হয়না, হিসেবে কবিতা মরে যায়। তোমাকে অভিমন্যুর গল্প বলি বরং। অভি আমার বন্ধু, এই শহরে সে শরীর বিক্রি করে'
রিনিকে সে অভির গল্প বলে যায়। এই ঝলকদেয়া শহরের চকচক প্রাসাদগুলোতে বিত্তবন্দী নারীরা বড় ক্ষুধার্ত। আসবাবের মতো বোধহীন,প্রেমহীন পুরুষেরা আর জলার্দ্র করতে পারেনা তাদের নারীদের । অভিকে ডেকে নেয় সেই সব অতৃপ্ত অথচ ক্রয়ক্ষম নারীগন।
রিনি'র কেমন ঘোর লাগে অভির গল্পে। রিনি ছলকে উঠে
-অনেক মজা তো ওর
-অনেক মজা, অনেক বিষন্নতা। অভিমন্যু একদিন ওর কান্নার গল্প বলেছিলো। কেঁদেছিলো-প্রথম যেদিন সত্য জেনে গিয়েছিলো, প্রেম ছাড়া ও শরীরের আনন্দ সবটুকুই পাওয়া যায়!
রিনির ভেজা হাত তার আঙ্গুল স্পর্শ করে। - তুমি বুঝি আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে অভিমন্যু'কেই দেখো?
আঙ্গুলের আর্দ্রতা সে অস্বীকার করে মুহুর্তে -তোমার রক্তে এবার সন্দেহ রিনি। সন্দেহে কবিতা হয়না মেয়ে। কমল, আমি, অভিমন্যু-আমরা তিনজন পরস্পর নিয়তির মতো গেঁথে গিয়ে একটা বৃত্ত এঁকেছি।বৃত্তের প্রতিটি রেখায় কবিতা ও বিষন্নতা।
তুমি সেই বৃত্তের অংশ হবে রিনি?
রিনি চলে যায়। রিনি ফিরে আসে...
এই উপন্যাসটি পড়েছি গতবছরের শেষের দিকে কিংবা এবছরের শুরুতে। উপন্যাসের সময় পরিক্রমা ১৯৮৪ থেকে ১৯৯১। ১৯৮৪ তে নিহত হন ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী, ১৯৯১ এ রাজীব গান্ধী। এই দুই হত্যাকান্ডের মধ্যবর্তী সময়ে ভারত রাষ্ট্রের নাগরিক জীবনের গল্পই এই উপন্যাসের প্রতিপাদ্য। অরবিন্দ আদিগা এই ফিকশনে ভারত রাষ্ট্রের রেপ্লিকা হিসেবে কিট্টুর নামে একটা জনপদের ছবি এঁকেছেন। কিট্টুর এর অবস্থান বলা হয়েছে আরব সাগরের তীরে, উত্তর-পশ্চিম উপকুলে। গোয়া ও কালিকটের মাঝামাঝি কোথাও। কিট্টুরে ধনী আছে, মধ্যবিত্ত আছে, দরিদ্র আছে। হিন্দু আছে, মুসলমান আছে, খ্রীষ্টান আছে। ব্রাম্মন আছে, দলিত ও আছে। আছে জাতপাত, বর্ণ ও সম্পদের বৈষম্য, দুর্নীতি, দারিদ্র, ভাষার অধিকারের প্রশ্ন, সংস্কৃতির জগাখিচুড়ি- ভারত রাষ্ট্রের যতো দায় বিদ্যমান তার সবই আছে কিট্টুরে। দুই প্রধানমন্ত্রীর হত্যাকান্ডের মধ্যবর্তী সময়ে কিট্টুর তথা রাষ্ট্রভারতের মানুষের জীবনযাপনের গল্প বলে গেছেন অরবিন্দ।
উপন্যাস হিসেবে কেমন?
আহামরি কিছু নয় কিন্তু চমকপ্রদ, অভিনব। অভিনব তার নির্মানে। এরকম চমকপ্রদ নির্মানকৌশল এর আগে কাউকে ব্যবহার করতে দেখিনি, আমি অন্ততঃ।
ছোট্ট করে বলা যাক। শুরু হয়েছে কিট্টুরের তথ্য ও বর্ননা দিয়ে যেমন কোন জনপদের তথ্য বিবরনী দেয়া হয় পর্যটক গাইডে। অরবিন্দ তার পাঠককে উপন্যাসের পাঠক নয় বরং তার তৈরী করা জনপদে পর্যটক হিসেবেই আমন্ত্রন করছেন। সাতদিনের একটা প্যাকেজ ট্যুর ও তৈরী করে দিয়েছেন। আপনি ভ্রমন শুরু করবেন প্রথম দিন সকাল বেলা কিট্টুর রেলস্টেশন থেকে। আপনার সামনে এসে দাঁড়াবে তুখোড় চটপটে এক চাল্লু কিশোর জিয়াউদ্দীন। স্থানীয় হিন্দু হোটেলের কর্মচারী সে,স্টেশন থেকে হোটেলের খরিদ্দার পাকড়াও করা চাকরী তার। নিজের মুসলমানিত্ব নিয়ে তার অশেষ গর্ব, দক্ষিন ভারতের এক গন্ডগ্রাম থেকে ক্ষুধার জ্বালায় শহরে এলেও কল্পনায় সে একজন পাঠান! আপনাকে সে বলবে- I'm a Muslim sir.We dont do hanky-panky'। হ্যাঁ, ইংরেজীতেই বলবে। প্রথম দিনের পুরো গল্প এই জিয়াউদ্দীন এবং তার পরিপার্শ্বের।
এইভাবে সাতদিন সাতরকমের মানুষের গল্প। প্রতিটি গল্প আলাদা। আপনি চাইলে প্রতিটিকেই স্বতন্ত্র গল্প হিসেবে পাঠ করতে পারেন আবার সাতটি খন্ড মিলে একটি পুর্নাঙ্গ উপন্যাস ও ভাবতে পারেন।যেমনই ভাবেন অরবিন্দ তার পাঠকপ্রিয় ভঙ্গী ও ভাষায় আপনাকে ভ্রমন করাবেন সাতদিন। সাতদিনে একটা পুরো জনপদ, একটা পুরো রাষ্ট্র!
'বিটুইন দ্যা এসেসিনেশন' এর রিভিউ লেখা আমার উদ্দেশ্য নয়। যারা রিভিউ পড়তে চান এখান থেকে দেখে নিতে পারেন দ্যা গার্ডিয়ান
নির্মানে চমকপ্রদ ও অভিনবত্ব আছে, পঠনে মসৃন। ভারত রাষ্ট্রের গল্প, তবু আমাদের যাপিত জীবনের ও। আর অরবিন্দ খুব দক্ষ ট্রাভেল কন্ডাকটর, চেনা জীবনে ও আলো না পড়া অনেক অন্ধকার রয়ে গেছে, তিনি সেই অন্ধকারে বিনা ক্লেশে পাঠককে পৌঁছে দিতে পারেন। তবু এই উপন্যাস কি আমি আরেকবার পড়ার তাড়না অনুভব করবো কিংবা ব্যক্তিগত সংগ্রহে রাখার? সম্ভবতঃ না।
কেনো নয়? দেখা যাক উত্তর পাওয়া যায় কিনা আপাতঃভিন্ন আলোচনায়।
ভালো লেখকদের আমি মোটাদাগে দুভাগে ভাগ করি। প্রথম ভাগের লেখকরা আবার তিনরকম। একরকম ভালো লেখকেরা পাঠককে নিয়ে যাত্রা শুরু করেন চেনা ও মসৃন পথে যেনো পাড়ার ছোট্ট পার্ক কিংবা শহরের চেনা নদীর পাড়। লেখকরা পুরোটা সময় পাঠকের পাশাপাশি থাকেন,পাঠককে ও তার পাশে থাকার জন্য জায়গা করে দেন। পাঠক ও লেখক মিলে আনন্দ, বেদনা, ক্ষোভ, হাস্য,হর্ষ, বিমর্ষতা ভাগাভাগি করেন।সবকিছু 'স্মুথ' থাকে। এরকম লেখকদের লেখা পাঠের জন্য পাঠকের প্রস্তুতির কোন প্রয়োজন পড়েনা। ফলে বেশীর ভাগ পাঠক খুশী। এরকম ভালো লেখকেরা তুমুল জনপ্রিয় হন। অরবিন্দ আদিগার 'বিটুইন দ্যা এসেসিনেশন' বিক্রী হয়েছে ১৬,০০০ কপি!
দ্বিতীয়রকমের ভালো লেখকেরা একটু এডভেঞ্চারাস। চেনা মাঠ, চেনা পথ ছাড়িয়ে এরা পাঠককে একটু অচেনায় নিয়ে যান। তবে খুব দূরে কোথাও নয় হয়তো শহরের শেষসীমানার উঁচু টিলা, বড়জোর ঝোঁকের বশে অন্য কোন শহরে। এরা পাঠককে কিছুটা ভাবান, কিন্তু পাঠক ভাবনায় একেবারে হারিয়ে যায়না দিনের শেষে সে নিজের নিরাপদ ঘরেই ফিরে আসে। ব্যতিক্রম দু একজন হয়তো এডভেঞ্চারের লোভে আবারো অচেনা পথে পা বাড়ায় তবে বেশির ভাগ পাঠকই শেষপর্যন্ত ঘর-গেরস্ত! ঘর-গেরস্তালীর ফাঁকে তারা হয়তো একদিনের এডভেঞ্চারের স্মৃতিচারন করে। ঐ অতোটুকুই ব্যাস। তৃতীয় রকমের ভালো লেখকেরা সাংঘাতিক, ভয়ংকর, বিপদজনক। স্বভাবতইঃ সংখ্যায় কম। এদের সাথে যাত্রা শুরু করতে হলে পাঠকের প্রস্তুতির প্রয়োজন। যথেষ্ট প্রস্তুতি নিয়ে শুরু করতে পারলে এই ভয়ংকর লেখকদের হাত ধরে পাঠক পৌঁছে যাবে এমন দিকশূন্যপুরে যেখান থেকে প্রত্যাবর্তনের আর কোন পথ থাকেনা। এরা হচ্ছে সেই লেখকেরা যারা লেখার মাধ্যম পাঠকের মনোজগত বদলে দিতে পারে। এবার আসি দ্বিতীয় ভাগে। এভাগে লেখকরা দুরকম।
প্রথমরকমের লেখকেরা হলেন বিয়ারের মতো। অতো আয়োজনের কিছু নেই। গ্রীষ্মের বিকেলে বাগানে কিংবা সমুদ্রতীরে বসে সহজেই চুমুক দেয়া যায়। মাত্রাভেদে এলকোহল কমবেশী থাকতে পারে। কোনটা ৪%, কোনটা ৫%। কোনটা বেশী চিলড, কোনটা বেশী সল্টি। তবে শেষপর্যন্ত কোনটাই উলটো লাথি মারেনা, যুক্তি-টুক্তি নিকেশ করে দেয়না, বেশ ক'টা টেনে-হালকা একটু আবেশ নিয়ে শেষপর্যন্ত ঝুটঝামেলা ছাড়াই চেনা রাস্তায় হেঁটে বাড়ি ফেরা যায়।
হুমায়ূন আহমেদ-শহিদুল জহির- গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ এরা হলেন এই গোত্রের ভালো লেখক। এইভাগের দ্বিতীয় রকমের লেখকেরা হলেন কড়া এলকো। ৫৫% এর পারনড কিংবা ৪৫% এর স্মৃনফ। না হলে নিদেনপক্ষে ৪০% এর জ্যাক ডানিয়েল। এরা সহজপাচ্য নয়, মৃদু ফুরফুরে আবেশ ছড়ায়না। বরং উলটো লাথি দেয়, ভেতর থেকে বেরিয়ে আসতে চায়। অপরিচিত অস্বস্তি ও অনুভূতিতে আক্রান্ত করে। কিন্তু একবার আস্বাদন করতে পারলে, একবার সেই মোহময় পতনে নিজেকে মুক্ত করতে জানলে অনুধাবন করে ফেলা যায় জীবন আসলেই অন্যত্র!
জরুরী নয়, তবু এরকম একটা জিজ্ঞাসায় আক্রান্ত হলো রাশেদ আনোয়ার, অক্টোবরের এক প্রায় শেষ হয়ে আসা বিকেলবেলা। মুলফটক দিয়ে বেশ ভিতরে এসে সে ঘুরে তাকাল। দেয়াল তখন অনেক দূরে, দেয়ালের বাইরের সড়ক তবু দৃশ্যমান। দৃশ্যমান সড়কের উপর নরোম রোদ, অথচ কবরস্থানে ছায়া ছায়া প্রায় অন্ধকার। সামিনার বলে দেয়া অনুযায়ী কবরটা এখানেই থাকার কথা। এইতো বড় একটা গাছ, গাছের পেছনে পাকা কবর, তার পাশেই। কিন্তু পাশের কবরটা তো বড় মানুষের, বছর চারেকের পুরনো ও মনে হচ্ছেনা। ঠিক এখানেই তো?
ছায়া মাড়িয়ে সে এসে দাঁড়ালো কবরটার পাশে।হয়তো এখানেই কবর হয়েছিলো, তার উপর আবার নতুন কবর হয়েছে। কতোদিন পর কবরের উপর নতুন কবর দেয়া হয়? কবর হয়ে যাওয়া মানুষগুলোর ঠিকানা কি কেউ লিখে রাখে এখানে? চারপাশে তাকালো সে অপ্রয়োজনে। উত্তর দেবার মতো কেউ নেই কোথাও। মুল ফটকের পাশে একটা অফিসের মতো দালান আছে কিন্তু তালাবদ্ধ। হয়তো আরো আগে আসতে পারলে কাউকে পাওয়া যেতো কবরটার খোঁজ করার জন্য। কিন্তু ঢাকা থেকে এই জেলাসদরের এসে পৌঁছাতে পৌঁছাতে বিকেল হয়ে গেলো। বাংলোটা শহরের বাইরে। সেখানে গাড়ি রেখে, কাপড়বদলে আসতে আসতে প্রায় সন্ধ্যা।
সামিনাকে কি বলবে সে? কবরটা চিনতে পারেনি?
অথচ সামিনা আসতেই চায়নি।প্রথম বিবাহবার্ষিকী উদযাপনে কেউ এমন জায়গায় বেড়াতে আসেনা যেখানে মৃত সন্তান শুয়ে আছে, বিশেষতঃ সেই বিবাহ যখন আর মৃত সন্তানের জনকের সাথে টিকে নেই।
তবু সে জোর করে রাজী করিয়েছে সামিনাকে। স্বপ্ন দেখিয়েছে এই শহরে আমরা একটা বাড়ি কিনবো।বুড়ো হয়ে গেলে আর ঢাকার ধুলোময়লায় নয় বরং এইশহরের চায়ের ঘ্রান আর মায়াবী সবুজে আমরা দুজন কাটিয়ে দেবো শেষদিনগুলো।
সামিনা দূরের দেয়ালের বাইরে মুল সড়কের পাশে দাঁড় করানো গাড়ীর ভিতর। এখানে তার গর্ভের সন্তান শুয়ে আছে, তবু সামিনার অধিকার নেই প্রবেশের।সামিনার হয়ে এই মাটি ছুঁতে এসেছে যেজন তার সাথে মাটিস্থ শিশুটির কোন সম্পর্ক নেই।
কোন প্রার্থনা নয়,কবরের মাটি কেবল নীচু হয়ে স্পর্শ করলো রাশেদ আনোয়ার।এক অযৌক্তিক, অবর্ননীয় পিতৃস্নেহর মতো অব্যাখ্য অনুভূতি তাকে আঁকড়ে ধরলো। তার তৃষ্ণা পেল প্রবল।ঐ তো দেয়ালের ওপাশেই সামিনা। তবু মনে হলো যেনো অনতিক্রম্য দূরত্বে। তৃষ্ণা নিবারনে জন্য এই দূরত্বটুকু অতিক্রম করা জরুরী।সামিনা কি তৃষ্ণার জল? অথচ একবছর কয়েক মাসে আগে ও তার এবং সামিনার পৃথিবী ছিলো পরস্পর থেকে অনেক দূরে, অনেক অচেনা, অনেক বিপরীত।
সামিনাকে নিয়ে অদ্ভূত,ব্যাখ্যাতীত কিছু ঘটে যা কিছু সে কাউকে বলতে পারেনা, সামিনাকে ও না।
সেদিন এক রেঁস্তোরায় বসে কফি খাচ্ছিলো তারা।আলবেয়ার কাম্যু কি করে তার লেখা সহ বদলে গেলেন এক্সিস্টিনিয়ালিজম থেকে এবসার্ডিজমে, বলছিলো সে। সামিনা কিছু বুঝছিলো, অনেকটুকুই বুঝছিলোনা।রাশেদ আগুন গরম কফিতে চুমুক দেয়,সামিনা ফুঁ দিতে দিতে কফি ঠান্ডা করে। ফুঁ দিতে দিতে সামিনা ঠোঁট টিপে হাসছিলো। তার হাসিতে শব্দ হয়না। তবু রাশেদ শব্দ শুনছিলো হাসির অথচ সামিনা নেই। সামিনা আছে, তার অস্তিত্ব টের পাচ্ছে সে, তার হাসির শব্দ শুনছে সে অথচ মুখোমুখি বসা ছিলো সামিনা। তবু সামিনাকে দেখছেনা সে। দৃষ্টিতে, দর্শনে সামিনা নেই!চারদিকে সব ছিলো, সবাই ছিলো। রেঁস্তোরার রঙ্গীন পর্দা, পাশের টেবিলে মুখোমুখি নির্বাক দম্পতি,মোবাইলের রিংটোন, সামিনার নিঃশব্দ হাসির শব্দ শুধু সামিনা ছাড়া।
হয়তো মুহুর্ত কয়েক।সামিনা হাত বাড়িয়ে স্পর্শ করেছিলো তার হাত।জিজ্ঞেস করেছিলো-হঠাৎ বিষন্ন কেনো?
দেয়া উত্তর মনে নেই এখন আর রাশেদ আনোয়ারের। মনে না হওয়ার অস্বস্তি নিয়ে সে উঠে দাঁড়ায়।সামিনার দিকে ফিরে যেতে যেতে হঠাৎ করেই যেনো মনে পড়ে যায় তার - এই শিশুটার মৃত্যু দরকারী ছিলো। সামিনার বেঁচে উঠার জন্য। সামিনাকে জড়িয়ে ধরে তার আরেকবার নিঃশ্বাস নেয়ার জন্য।
২।
পায়ের কাছে জোছনা এসে লুটোপুটি খেললে তার ঘুম ভেঙ্গে যায়।
জানালা খোলা ছিলো। অক্টোবরের রাতে এই পাহাড়ী শহরে আলতো করে শীত পড়তে শুরু করে। দরজার ওপাশে টানা বারান্দা। সামিনা উঠে তার নিরাভরন শরীরে আলগা করে শাড়ী জড়ায়।রাশেদ ঘুমিয়ে আছে, ঘুমিয়ে পড়া মুখে তার এক চিলতে হাসি, তৃপ্তি ও সারল্যের। রাশেদের নগ্ন শরীরে চাদর টেনে দিয়ে সামিনা এসে দাঁড়ায় বারান্দায়।
বাংলোটা শহর থেকে বেশ বাইরে একটা পাহাড়ের চুড়ায়।রাত হয়তো প্রায় শেষ।হালকা কুয়াশা পড়েছে, আশেপাশের পাহাড়গুলো জমাটবাধা গাঢ় সবুজের মতো।অনেক দূরের উঁচু পাহাড়ে ছেড়া ছেড়া আলো। রাশেদ বলছিলো ওটা মেঘালয়ের পাহাড়,আলোগুলো খাসিয়া পুঞ্জি। রাশেদ বলছিলো- মেঘালয়ে যেতেই হবে একবার। ওখানে মাথার উপর দিয়ে থোকা থোকা মেঘ ভেসে যায়,হাত দিয়ে সেই মেঘ ছুঁয়ে যায়।
এই লোকটার সাথে দেখা না হলে, এই লোকটার সাথে জীবন নতুন করে শুরু না করলে কতোকিছু অজানা থেকে যেতো সামিনার। কিন্নর বলে অনেক উঁচুতে নাকি একটা জায়গা আছে, সে জায়গার মেয়েরা স্বর্গের অপ্সরাদের চেয়েও সুন্দরী,কোন কোন আদিবাসী গ্রামে ফসল বুনতে যাওয়ার আগে পুরুষেরা নিজ নিজ নারীদের পুজো করে কেননা নারীরাই তো শস্যমতী, উৎপন্নের আঁধার।এতো কিছু জানা হতোনা সামিনার, এমনকি নিজের শরীর। শরীরের চরম তৃপ্তি, অর্গাজম,মাল্টি অর্গাজম, বিছানায় আধিপত্য নেয়া!
অথচ বিবাহিত জীবনের চারটা বছর কি দুর্বিষহ সমর্পণ ছিলো সামিনার। লোকটা এই শহরে চাকরী করতো, বিয়ে করে তাকে নিয়ে এসেছিলো।লোকটা ভালো ছিলোনা, লোকটা মন্দ ছিলোনা। তার কোন অভিব্যক্তি ছিলোনা, তার কোন প্রতিক্রিয়া ছিলোনা। অফিস শেষে সন্ধ্যেবেলা বাড়ি ফিরে টিভি দেখতো, সাথে থাকা মা-বোনের সাথে কথা বলতো, খাওয়া দাওয়া শেষ হলে পর দরজা লাগিয়ে মৃয়মান সামিনাকে টেনে নিতো।ক্লান্তিকর রমণ শেষে সিগারেট টেনে ঘুমিয়ে পড়তো।
দুবছরের বাচ্চাটা শেষপর্যন্ত মারা যাওয়ার পর সরকারী কবরস্থানে দাফন শেষে ঘরে ফিরে ও সে সিগারেট টেনেছিলো। তিনদিন পর সামিনাকে টেনেছিলো, সামিনা ঊরুর ভাজ খুলে দিয়েছিলো নিরবে।কয়েক মিনিট পরে আবার সিগারেট টানতে টানতে বলেছিলো- মরা বাচ্চাকে ভুলতে তোমার আরেকটা বাচ্চা দরকার।
সামিনা ভুলতে চায়নি তো! দুবছরের বাচ্চা, জন্ম থেকেই যার হৃদপিন্ডে ছিদ্র,শ্বাস নেয়ার সময় গড়গড় আওয়াজ উঠতো, নীল হয়ে যেতো ফর্সা তুলতুলে দেবশিশু সামিনা তাকে ভুলতে চায়নি কখনো। তবু লোকটার কি বিভৎস রমণ! সামিনা তখন কাঁপতো, পানিতে হাত ডুবিয়ে কাঁদতো, ক্ষিধে লাগতে লাগতে শরীর অবসন্ন হয়ে পড়তো কিন্তু কিছু খেতে পারতোনা।তবু লোকটার যেনো মরনপণ জেদ আরেকটা সন্তান জন্ম দিয়ে মৃত সন্তানকে ভুলে যাবে,ভুলিয়ে দেবে! পরপর দুবার গর্ভপাতের পর সামিনার আর ঊরুর ভাজ খুলে দেবার শক্তিটুকু ও অবশেষ নেই।
সামিনা হয়তো মরেই যেতো। তার ফিরে যাবার কোন জায়গা ছিলোনা। বাবা ছিলেননা, শয্যাশায়ী মা বড়বোনের সংসারে , ছোটভাই দুবাই। তবু সামিনা বেঁচে উঠলো শামীম ভাই ইংল্যান্ড থেকে ফিরে আসার পর।খালাতো এই ভাইটির স্নেহ ছিলো তার জন্য সবসময়। সামিনাকে জোর করে নিয়ে আসলেন তিনি।
একবছর পর রাশেদের সাথে সামিনার বিয়ের আয়োজন ও তার করা। বলেছিলেন সামিনাকে- জীবন ফুরিয়ে যায়না কখনোই।আরেকবার সাহস করে শুরু কর। রাশেদ অন্য রকম ছেলে।ইংল্যান্ডে ফিরে যাবেনা বলে ওর স্ত্রী সন্তানকে নিয়ে ফিরে গেছে, ওরা ফিরবেনা আর। ও বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ায়,তুই ও তোর পড়াশুনোটা শেষ কর।
শামীম ভাই তাকে এই উপলব্দি দিয়েছিলেন জীবন হলো ষাঁড়ের লড়াই। সাহসী ম্যাটাডোরের মতো লড়তে না জানলে প্রথম রাউন্ডেই ফুরিয়ে যেতে হবে, রক্তাক্ত, ছিন্নভিন্ন হয়ে ছিটকে বেরিয়ে আসতে হবে। আর লড়তে জানলে হারতে হারতে ও শেষ মুহুর্তে জিতে যেতে পারে রক্তাক্ত মানুষ।
সামিনা জানে সে জিতে গেছে শেষপর্যন্ত। রাশেদ তাকে প্রথম জানিয়েছি কেবল ঊরুর ভাঁজ খোলে দেয়াই জীবন নয়। জীবন অন্যত্র, জীবন আরো কিছু।চলে যাওয়া সন্তানের জন্য রাশেদের গভীর বেদনাবোধ আছে, কিন্তু নতুন সন্তান জন্ম দিয়ে সেই বেদনা মুছে দেবার কোন তাড়া নেই তার। সামিনার হাতের আঙ্গুল নিয়ে খেলতে খেলতে বলছিলো সে- আমাদের মাঝখানে তৃতীয় কারো কী দরকার? এমনকি সন্তান! দুজন দুজনকে জড়িয়ে থেকে জীবন ফুরিয়ে দেবো। শুন্য করে চলে যাবো ভাণ্ডার!
এই শহরে এসে স্থায়ীভাবে থাকার স্বপ্ন দেখে রাশেদ। সামিনা জানে,এটা তার মৃত সন্তানের প্রতি রাশেদের সৌজন্যপ্রকাশ। রাশেদ তার মাতৃত্বকে শ্রদ্ধা করে, রাশেদ চায় সামিনা ভালো থাকুক তার সন্তানের কাছাকাছি। মৃত সন্তান।
অথচ সামিনার বড় অস্বস্তি হয়।গোপন পাপের মতো এক তীব্র অস্বস্তি তাকে আক্রান্ত করে। রাশেদ তার জীবনের আসার পর এই অস্বস্তি সে আবিস্কার করে। বড় সিদ্ধান্তহীন,পরিনতিহীন এই আবিস্কার, যেনো না হলেই সে বেঁচে যেতো। অথচ জানে সে- আদতে এই আবিস্কারই বাঁচিয়ে তুলেছে তাকে।
মৃত সন্তানের কথা মনে হলে এখন আর সামিনার কোন কষ্ট হয়না। আজ বিকেলে যখন সে একা বসেছিলো গাড়িতে আর রাশেদ গিয়েছে কবরস্থানের ভেতরে তখনো মৃত সন্তানের মুখ ভাসছে তার চোখের সামনে। ঐ ছোট ছোট হাত পা, তুলতুলে শরীরের ঘ্রান,শ্বাসকষ্ট সব স্পষ্ট মনে পড়ে তার কিন্তু এই মনে পড়ায় এখন আর কোন কষ্ট পায়না সে, যে কষ্ট নিয়মতান্ত্রিক, বাঞ্চিত। বরং একটা তীব্র সুখের মতো অনুভূতি জাগে খুব গোপনে।
সুখ? সুখের মতো?
মৃত সন্তানের স্মৃতিচারনে সুখের মতো অনুভূতি? সামিনার ভয় ভয় জাগে। নিজেকে পিশাচিনীর মতো মনে হয় তবু এই সুখের মতো অস্বস্তি সে অস্বীকার করতে পারেনা।এই সন্তান বেঁচে থাকলে সে নিজে আজকের এই বেঁচে থাকা জীবনটা যাপন করতে পারতোনা।
কবরস্থান থেকে বাংলোয় ফিরে আসার পথে রাস্তার পাশে একটা পাহাড়ে তারা থেমেছিলো। সূর্য তখন ডূবছে। রাশেদ বলছিলো চলো পাহাড়ের চুড়োয় বসে সূর্যাস্ত দেখি।পাহাড়ের ঢালে একটা গলফ কোর্স। অবশ্য ছেলেরা গলফ নয় ক্রিকেট খেলছিলো। পাশ দিয়ে হেঁটে যাবার সময় ওরা তাকিয়ে ছিলো। কেউ একজন বোধহয় কিছু বলছিলোও। সামিনার ভালো লাগছিলোনা। রাশেদ হাসছিলো- শরীর নিয়ে তোমার অস্বস্তি এখনো গেলোনা।ছেলেরা তোমার প্রশংসা করছে।
বাংলোয় ফিরে আসার পর রাশেদ বশংবদ দাসের মতো প্রশংসা করছিলো তার শরীরের। সামিনা ওর কৌশল জানে। সামিনাকে জাগিয়ে তোলার জন্য এইসব বদমায়েশী সে খুব ভালো জানে। সামিনাকে নিরাভরন করতে করতে বলছিলো এই পাহাড় চুড়োর রাতে তুমি কাউগার্ল হও। মাই ডিয়ারেস্ট হর্নি গার্ল!
ঘন্টা কয়েক আগের খুনসুটি মনে পড়তে পড়তে সামিনা টের পায় তার শরীর জাগছে আবার। যে শরীর মরে গিয়েছিলো, ঊরুর ভাঁজ খুলে দেয়া ছাড়া যে শরীরের আর কোন ভূমিকা ছিলোনা সে শরীরের এই তীব্র প্রানময়তা সামিনাকে এখন তুমুল দোলায়।
বারান্দায় থেকে জানলা দিয়ে সে ঘরের ভিতর দেখে। রাশেদ ঘুমিয়ে আছে। এই ঘুমন্ত রাশেদকে তেমন পুরুষ মনে হয়না তার এই মুহুর্তে। বরং সারল্য আর তৃপ্তি নিয়ে সে শিশুর মতো,যেনো তার গর্ভজাত শিশু।
সামিনা মুখ ফিরিয়ে নেয়। শরীরের জেগে উঠা আরো তীব্র হচ্ছে। চাঁদ চলে গেছে মেঘের আড়ালে। অন্ধকারে আরো অধিকতর জমাট বেঁধে আছে চারপাশের জঙ্গল, প্রকৃতি। সামিনা আলগা হয়ে থাকা শাড়ী সরিয়ে ফেলে তার শরীর থেকে।
প্রকৃতি এক প্রবল পুরুষ হয়ে জেগে উঠছে। শেষরাতের ঠান্ডাবাতাস, অন্ধকার আকাশে জেগে থাকা তারা, দূরের পাহাড়ের আলো, বনের জমাট সবুজ সব এক কাঠামোতে মিশে গিয়ে তৈরী হচ্ছে প্রবল পুরুষের আকার। সামিনা কেঁপে কেঁপে উঠে। টের পায় তার ঊরুর ফাঁকে প্রস্তুতি।যে পুরুষ আসলে নেই, প্রকৃত সেই প্রবল পুরুষের উত্থিত প্রবেশের জন্য টানটান প্রতীক্ষারত শরীর। সামিনার।
কে কোথায় নিভে গেছে তার গুপ্ত কাহিনী জানি। নিজের অন্তর দেখি, কবিতার কোন পঙতি আর মনে নেই গোধূলিতে; ভালোবাসা অবশিষ্ট নেই। অথবা গৃহের থেকে ভুলে বহির্গত কোনো শিশু হারিয়ে গেছে পথে, জানেনা সে নিজের ঠিকানা [সন্তপ্ত কুসুম ফোটেঃ বিনয় মজুমদার]
(উৎসর্গঃ- প্রিয় শিমুল, আনোয়ার সাদাত শিমুল'কে- যে একদিন বড় হয়ে, আরো বড় গল্পকার হবে)
১. ঘুমের ভেতর অসুখের ঘ্রান পায় হাসান অথবা অসুখের ঘ্রানে ঘুম ভাঙ্গে। ঘুম ভাঙ্গে কিন্ত চোখ খুলতে পারেনা, চোখ খুলে তাকাতে পারেনা। যেনো চোখের ভেতরে মুঠো মুঠো বালি ঠেসে দেয়া। কড়কড়ে অস্বস্তি। দু হাত উপরে চেপে ধরে ধীরে ধীরে খুলতে গিয়ে যেনো সে ঝলসে যায়, চোখের উপর হাজার ওয়াটের বাতি জ্বলছে। আঙ্গুলের ফাঁক দিয়ে দৃষ্টি গেঁথে যায় অনেক উঁচুতে জানালার গরাদে। গরাদ ঠেলে রোদ আসছে অথচ বাতাস নেই। ফুসফুসে হাসফাস। এই কারাগার থেকে সহসা মুক্তি নেই, জেনে তবু কি এক অবোধ্য তাড়নায় সে লাফিয়ে উঠে গরাদ ভাঙবে বলে। ঘোর। ঘোর কাটলে পরে হাসান টের পায় এটি তার ব্যক্তিগত শোবার ঘর মাত্র। গত রাতে বাতি নেভানো হয়নি। জানালার পর্দা ও টানা হয়নি। বেলা অনেক। বাইরের কড়া রোদ ঘরের ভেতর। ২. বাচ্চাদের স্কুলের সকালের শিফট শেষ হবার আগে আগে রাস্তার উল্টোপাশে এসে দাঁড়ায় হাসান। পাড়ার ময়লা নিয়ে যাচ্ছে একটা ভ্যান। ভ্যানের পেছন থেকে ময়লা গড়িয়ে পড়ছে রাস্তায়। মাইকে প্রবল চিৎকার। মানুষের অহেতুক ছুটোছুটি। স্কুলের গেটে এসে ভীড় করছে অভিভাবকরা। হাসানের কোন তাড়া নেই। অফিস ছুটি সপ্তাহখানেকের। কোথাও তেমন যাওয়ার নেই। বাচ্চারা সব বের হয়ে আসার পর একজন দুজন করে মিস্ট্রেস ও বের হতে থাকে। একেবারে পেছনে চৈতী। হাসান রাস্তা পেরোয়। চৈতী হাত নাড়ে। কলাপাতা রংয়ের জামা, চুল বেনী করা- ওকে বালিকা বিদ্যালয়ের নবম শ্রেনী বলে ভ্রম হয়। চোখমুখে রোদ ঝলমল আলো ফুটিয়ে ও এসে হাসানের বাহু স্পর্শ করে।-‘ চলো আইসক্রীম খাবো’ কিছুটা দূর হেঁটে ওরা আইস ক্রীম পার্লারে ঢুকে। ফালুদার গ্লাসে চুমুক দিতে দিতে চৈতী বলে- তোমার তো ছুটি, চলো কাল কোথাও বেড়াতে যাই সারাদিনের জন্য। আমি ছুটি নিতে পারবো। আইস ক্রীম পার্লারের ঠান্ডায় হাসানের ঘুম পায়। থুতনীতে হাত ঠেকিয়ে বলে-কোথায় বেড়াতে যাবে? এই শহরে নিঃশ্বাস নেয়ার মতো কোন জায়গা খুঁজে পাইনা আমি চৈতী জানায় শহরের ঠিক অদূরেই নাকি একটা বিনোদন পার্ক হয়েছে। পার্কের ভেতরে পাহাড় আছে। পাহাড়ের নির্জনতায় ছোট ছোট কুটির। চাইলে সারাদিনের জন্য ভাড়া নেয়া যায়। শহরের সব প্রেমিক প্রেমিকেরা নাকি পয়সা খরচ করে প্রেম করতে ভীড় করছে ঐসব ভাড়াটে কুটিরে। হাসান হাসে- যাওয়া যায়, পুরো দিনের জন্য আমরা ও একটা কুটির ভাড়া নিতে পারি।তবে কাল না। অন্য দিন। -কাল নয় কেন? - কাল বিকেলে অথৈর ডাক্তারের এপয়েন্টমেন্ট আছে। -ওহ! তারপর ক’মুহুর্তে শীতাতপ যন্ত্রের একটানা আওয়াজ ছাড়া আর কোন শব্দ থাকেনা।হাসান টেবিলে আঁকিবুকি কাটে। চৈতীই ফের কথা বলে -কি অবস্থা মেয়েটার? -ভালো না। ডাক্তাররা কিছুই ধরতে পারছেনা। ডায়াগোনোসিস চলছে একটার পর একটা।কিন্তু -ওর বাবা একটা অমানুষ -ওঁহু। সবই পরিস্থিতি। -একমাত্র মেয়ের এই অবস্থায় সে বিদেশে পড়ে থাকতে পারলো? -সে বিদেশে আছে বলেই অন্ততঃ মেয়েটাকে বাঁচানোর চেষ্টা করা যাচ্ছে -বাচ্চাটাকে ওর বাবা চিকিৎসার জন্য নিয়ে যেতে পারেনা? -নাহ। ও নিজেই এখনো বৈধ হতে পারেনি। -ও তোমার খুব ভালো বন্ধু ছিলো, তাইনা? হাসান কথা বলেনা। বিরক্ত হয়। চৈতীকে আগে ও বলেছে, তবু কি এক অদ্ভূত কারনে এই প্রশ্ন সে বার বার করে। অথৈ’র বাবা ফয়সাল কখনোই ওর বন্ধু ছিলোনা। সহকর্মী মাত্র। হাসান যখন অফিসে জয়েন করে ফয়সাল তখন মাত্র ক’দিন হয় বিয়ে করেছে প্রেম করে। দু পরিবারেরই অসম্মতিতে।সে দুপুরের লাঞ্চ নিয়ে আসতো বাসা থেকে। হাসানকে জোর করে খাওয়াতো। একদিনের জন্য ও সে হাসানকে বাইরে লাঞ্চ করতে দেয়নি। বাসায় নিয়ে গেছে। ওর বৌ নীলার সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছে, নীলার তখন বাচ্চা হবে। বাচ্চা হবার সময় প্রচুর রক্তপাত হলো, কাকতালীয় ভাবে রক্তের গ্রুপ মিলে গেলো হাসানের সাথে। হাসান রক্ত দিলো। বছর খানেক পর অফিসের এক প্রোগ্রামে আমেরিকা গিয়ে যখন ফয়সাল আর ফিরলোনা নীলা তখন হাসানকেই জানালো এটা তাদের পুর্ব পরিকল্পিত, আর্থিক দৈন্যদশা মেটানোর নাকি আর কোন পথ ছিলোনা। আরো ক’দিন পর যখন অথৈ মেয়েটা অসুস্থ হলো- নীলা হাসানকেই জানালো, , আমেরিকা থেকে ফয়সাল ফোন করে অনুরোধ করলো ওর মেয়েটাকে নিজের মেয়ের মতো করে দেখতে, ওদেরকে দেখার আর কেউ নেই। বন্ধন ভাল্লাগেনা, তবু জড়ায়-হাসান তবু জড়াতে থাকে নানা বন্ধন ও বিমুগ্ধতায়। চৈতী হাসানের চুলে হাত ছোঁয়ায়। বলে- ‘আমার কিন্তু ভালো লাগে, এই যে একটা বাচ্চার জন্য তোমার এতো কেয়ার।তুমি খুব ভালো বাবা হবে, আমার চিন্তা নেই’ হাসান হাসে-‘ কি জানি, আমার বরং লালন ফকিরকেই ভালো লাগে।বলেছিলেন- জন্ম দিওনা, জন্ম দিলে আত্না খন্ডিত হয়ে যায়।‘ -'হয়েছে। তুমি লালন না। তুমি হলে হাসান। আমার হাসান' প্রায় নির্জন আইসক্রীম পার্লারে চৈতী আরো ঘন হয়ে আসে, ঘন হয়ে আসে ওর চুলের ঘ্রান। হাতের আঙ্গুল নিয়ে আনমনে খেলতে খেলতে ও বলে- যাবে এখন আমার সাথে? মেয়েটাকে দেখে আসি। ওর মা একেবারে একা। চৈতীর হাত ফিরে যায়। যেতে যেতে বলে - 'আজ আমার কাজ আছে।অন্য কোন দিন যাবো। আজ তুমি একাই যাও' তারপর আর তেমন কথা এগোয়না। সমস্ত সুঘ্রান নিয়ে মেয়েটা চলে যাওয়ার পর ‘একা’ শব্দটা বড় ভারী ও তপ্ত হয়ে উঠে হাসানের জন্য।হিমহিম আইস ক্রীম পার্লারে ফিরে আসে সকালের হাসফাস, অসুখের ঘ্রান। ক’বছর আগে কলেজের বন্ধু এন্টনীর সাথে ও বেড়াতে গিয়েছিলো খাসিয়া পল্লীতে। এন্টনীর দাদী থুত্থুড়ে বুড়ি নাকি হাত দেখে ভবিষ্যত বলে। কৌতুহলে সে ও বসেছিল বুড়ির পাশে। হাত ধরে রেখে দীর্ঘক্ষন, ফিসফিসিয়ে বুড়ি বলেছিল-‘ তোর তো শরীর ভরা অসুখ রে ব্যাটা!’ শরীর ভরা অসুখ নিয়ে গ্লাসডোরে ঠেলে বেরিয়ে আসে হাসান। ৩. বাইরে প্রবল রোদ। থকথকে মানুষের দল। দলবদ্ধ জটলা। অথৈদের বাসায় যাবার জন্য রিক্সা, টেক্সী কিচ্ছু নেই।অলংঘনীয় জ়্যামে আটকে আছে গোটা শহর। জ্যামে আটকে আর্তনাদ করছে একটা ফায়ার সার্ভিসের গাড়ী। একটানা হর্ণ বাজাচ্ছে। একচুল নড়ছেনা কেউ। হাসান রাস্তায় নেমে এসে হাঁটতে থাকে। ফুটপাত বলে কিছু নাই। মানুষের শরীরের উপর দিয়ে গড়িয়ে হাঁটছে মানুষ। ছুটছে আরেকদল। আরেকদিক থেকে হর্ণ বাজাতে বাজাতে চলে গেলো পুলিশের গাড়ী। কেউ একজন চিৎকার করে বললো-শহরের প্রধান বিপণীতে আগুন লেগেছে। বেশ উঁচুতে আগুনের শিখা। অনে দূর থেকে তার হল্কা এসে ধাক্কা দিলো। হাসানের শরীর জ্বলছে। কাল ফেরার আগে পিঠে নখের আঁচড় বসিয়ে দিয়েছিলো নীলা।সারা রাত জ্বলেছে, এখন জ্বলছে আবার । শহর জ্বলছে। শরীর ভর্তি আগুন নিয়ে হাসান দৌড়ায় এবার। দৌড়ের ভেতর অসুখের ঘ্রান পায় হাসান অথবা অসুখের ঘ্রান নিয়েই দৌড়ায়। দৌড়ায় অথচ চোখ খুলতে পারেনা, চোখ খুলে তাকাতে পারেনা। যেনো চোখের ভেতরে মুঠো মুঠো বালি ঠেসে দেয়া। কড়কড়ে অস্বস্তি।