Tuesday, May 19, 2009

।।ব্যক্তিগত পোষাক।।




কফিপটে উত্তাপ।ফুলদানীতে তাজা ফুল।ঘ্রানহীন,রংচঙ্গে।জানলায় ভারী পর্দা।দেয়ালজুড়ে আয়না।
শামীম হায়দার আয়নায় নিজেকে দেখলেন।নিজের প্রতিবিম্ব দেখলেন।শরীরের শীর্নতা ফুরিয়েছে অনেক আগেই।তলপেটে কিছুটা মেদ জমলেও নিজের নগ্ন শরীরকে এখনো ভালো না লাগার মতো সময় আসেনি।শিশ্ন আপাতঃ শিথিল।
কোমরে তোয়ালে জড়ালেন। ভারী পর্দা সরালেন কিঞ্চিৎ।বিকেলের আলো এলো ঘরে।
বালিশে মুখ গোঁজে থাকা সোহানা আক্তার মুখ ফেরালেন।ভ্রুঁতে প্রশ্নবোধ।
শামীম হায়দার পর্দা টেনে দিলেন।
হলিডে হোমসের এই ঘরে এখন আর বিকেল নেই।
স্ত্রী জানেন জরুরী মিটিং আছে।মিটিং শেষে ডিনার পার্টি।ফিরতে রাত হবে।বেশ রাত।বিদেশী ব্যাংকের স্থানীয় শাখার প্রধান ব্যবস্থাপকের এমন রাত হয়। স্ত্রী অভ্যস্ত। সন্তানদ্বয় ও।
বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের উর্ধ্বতন প্রভাষিকা সোহানা আক্তারের ব্যবসায়ী স্বামী আমদানী কাজে সিঙ্গাপুর।একমাত্র সন্তান শ্বাশুড়ীর কাছে নিরাপদ।ছাত্র-ছাত্রীদের একটা অনুষ্ঠান আছে।ফিরতে দেরী হবে।
শামীম হায়দারের ব্যাংক সোহানা আক্তারের বিশ্ববিদ্যালয় দুটোই যথাক্রমে একটি সুপারমার্কেটের চতুর্থ সপ্তম তলায়। সতের বছর তাদের দেখা হয়নি।দেখা না হওয়ার সতের বছর তারা সুপার মার্কেটের চতুর্থ সপ্তম তলায় কার্যরত ছিলেন তেমন ভাবনার কোন কার্যকারন নেই।
শামীম হায়দারের বাবা ছিলেন মফস্বল শহরের সমাজসেবা কর্মকর্তা। আর সোহানা আক্তারের বাবা ছিলেন শিক্ষা কর্মকর্তা। দু কর্মকর্তাই সেই মফস্বলে বদলী হয়ে এসেছিলেন অন্য কোন মফস্বল থেকে।উপজেলা চত্বরের মধ্যে পাশাপাশি নিবাস ছিলো তাদের। শামীম হায়দার সোহানা দুজনই তখন অষ্টম শ্রেনী।
শামীম হায়দার বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয়-কালো প্যান্ট,সাদা সার্ট,বাটার জুতো। সোহানা আক্তার উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়- সাদা সেলোয়ার,আকাশী জামা, সাদা উড়না।সোহানা ইতিমধ্যে প্রেমে পতিত।উপজেলা চেয়ারম্যানের চাচাতো ভাই যে কলেজের একাদশ শ্রেনীতে, সে টিফিন পিরিয়ডে বালিকা বিদ্যালয়ের গেটে এসে দাড়ায়। সাইকেলের টুংটাং আওয়াজ হয়।চিঠি বিনিময় হয়।একদিন সন্ধ্যেবেলা বিদ্যুৎবাতি কোন কারনে না জ্বললে উপজেলা শিক্ষাকর্মকর্তার সরকারী নিবাসের দেয়াল টপকে কে যেনো ভেতরে ঢোকে। কর্মকর্তাটি স্ত্রী সমেত গিয়েছিলেন দাওয়াত খেতে এক বিদ্যালয় শিক্ষকের বাড়ীতে। বৃত্তি পরীক্ষা সমাগত বলে একমাত্র কন্যাটি একাকীই ছিলো।
শীর্ণ শামীম হায়দার তার জন্য বেজায় ভারী ছাত্রসখা বইটি নিয়ে সেই সন্ধায় কড়া নেড়েছিল সোহানাদের দরজায়। দরজা খুলেনি কেউ। আসন্ন বৃত্তিপরীক্ষার ইংরেজী রচনা কোনটা বেশী ইম্পোর্টেন্ট - ‘এইম ইন লাইফ’ নাকি ‘জার্নি বাই বোট’ সেই সিদ্ধান্তে আসা জরুরী ছিলো তার জন্য, জরুরী ছিলো সোহানার সাথে কথা বলা। তাই ক্রমাগত কড়া নাড়া প্রত্যাখান তাকে অসহিষ্ণু করে তুলছিল। পেছনের দেয়ালের নীচ দিয়ে ভিতরে ঢোকার একটা পথ জানা ছিলো তার। দেয়াল টপকানো ক্লেশটুকু করতে হয়নি তার।
যে উপগত ছিলো সে দেখিনি, যে শয্যাগত ছিলো সে দেখেছিলো। শামীম হায়দার পালিয়ে এসেছিলো।
একুশ বছর পর, সুপারমার্কেটের ছাদে গড়ে উঠা বাহারী রেঁস্তোরার একবারে কোনার টেবিলে বসে সোহানা আক্তার যখন বলছিল- ‘অনেক দিন আমি অর্গাজমের আনন্দ পাইনি’ শামীম হায়দারের মনে পড়ে গিয়েছিল সেই সন্ধ্যা, সেই সন্ধ্যায় কি আনন্দ পেয়েছিল সে?
জিজ্ঞেস করা হয়নি। কিন্তু সেই রাতে, রেঁস্তোরা থেকে ফিরে আসার পর রাতে তার স্ত্রী দীর্ঘদিন পর অর্গাজমের আনন্দ পান।চোখ বন্ধ নি;শ্বাস নিচ্ছিল শামীম অর্ধ-উত্থিত শিশ্নে ঠোঁট বুলিয়ে স্ত্রী বিড়বিড় করেন- ‘আই লাভ ইউ ম্যান’
খোলাপিঠ নিয়ে সোহানা আক্তার আবার উপুড় হন। শামীম জানালার কাছ থেকে ফিরে আসেন।
-কিছু বলবে?
-নাহ
-খারাপ লাগছে?
-নাহ
-অনুশোচনা
-নাহ!
বিছানার পাশে একটা সিডি প্লেয়ার।আগে খেয়াল হয়নি কারো। খেয়াল করার মতো ধৈর্য্য ছিলোনা কারো।আলগোছে বাটন টেপা হয়। অপরিচিত কন্ঠ গেয়ে উঠে চেনা গান
‘চেয়ে থাকি দাঁড়িয়ে দ্বারে, চেয়ে থাকি
যে ঘরে প্রদীপ জ্বলে তার ঠিকান কেউ না বলে
বসে থাকি, বসে থাকি পথের নিরালায় গো
চিররাতের পাথার পাড়ে হায়গো…
এয়ারকন্ডিশনারের ঠান্ডায় শীতবোধ হয়।
শামীম হায়দার কফিপট থেকে কফি ঢালেন। এক কাপ। এক কাপ খালি থাকে। ভারী পর্দা সরান আবার। সন্ধ্যা ঘনাচ্ছে। এখন আর বিকেলের রোদ নেই। ঘরের ভেতর আলোর প্রবেশ নেই। সোহানা আক্তার তার খোলা বুক নিয়ে চোখ মেলেননা এবার।
হলিডে হোমসের বাইরের দিকের বাগানে একজোড়া ছেলেমেয়ে।পরস্পরকে জড়িয়ে আছে। মেয়েটার হাতে কিছু একটা। অতোদূর থেকে স্পষ্ট বুঝা যায়না। আইসক্রীম হতে পারে। মেয়েটা ছেলেটার মুখে তুলে দিচ্ছে। দুজন হাসছে।
শামীম হায়দার, সোহানা আক্তারকে শুনিয়ে বলেন- 'দেখো, ওরা প্রেম করছে।'

Tuesday, May 05, 2009

।। কবি ও প্রেমিকাগন ।।



আমার এমন হয় ।
দীর্ঘ প্রস্তুতির বিনিময়ে কোন কোন কাজ শেষ করতে গিয়ে, শেষ মুহুর্তে আমাকে আঁকড়ে ধরে অবসন্নতা । মনে হয়, থাক । বরং বাদ দেই, বরং ফিরে যাই…
প্রথম যেদিন রিমি’র জামার বোতাম খুলেছিলাম-আমার দীর্ঘ প্রস্তুতি ছিল সেটা,মনে আছে । কারো কারো এইসব সহজে হয়ে যায় । আমার হয়না । বেশ তো ক’দিন হয়ে গেল । এখনো মনে আছে, রিমি’র জামায় পাঁচটা বোতাম ছিলো । ও চোখ বুঁজে ছিলো । আমি প্রথম বোতামে বেপরোয়া ছিলাম,দ্বিতীয় বোতামে কামার্ত, তৃতীয় বোতামে সাহসী হয়ে চতুর্থ বোতামে অবসন্নতা ।মন বলছিল- থাক এতোটুকুই, বাদ দেই এবার, ফিরে যাই । মুহুর্তের অমনোযোগীতায় রিমি চোখ খুলেছিল আর হাতের আঙ্গুল ও অবাধ্য হয়েছিল আমার ।
এই বিকেলে কালো গেটের সামনে দাঁড়িয়ে সেই একই রকম ফিরে যাওয়ার আকুতি টের পাই নিজের ভেতর অথচ এই বিকেলের জন্য, এই গেটের সামনে দাঁড়ানোর জন্য কতোদিনের অপেক্ষা আমার!
এবারো হাতের আঙ্গুল অবাধ্য হয়ে উদ্ধার করে আমাকে । কলিং বেল চাপি ।
মধ্যবয়স্ক কাজের লোক এসে গেট খুলে দেয় ।
আমার কি কিছুটা মন খারাপ হয়?

লোকটা নাম জিজ্ঞেস করে,তারপর জানান দেয়-তিনি ভেতর ঘরে অপেক্ষায় আছেন । আমি লোকটাকে অনুসরন করি কেবল । অনুসরন করতে করতে ঘাড় ঘুরিয়ে বাড়ীটা দেখি । খুব পুরনো নয় অথবা বাড়ীটা পুরনোই,নতুন করে সাজানো হয়েছে । দোতলায় টানা ছাদ, নিচে বেশ বড় একটা বাগান, বাগান পেরিয়ে মুল বারান্দা । আমরা বারান্দায় উঠি । বারান্দা পেরিয়ে ভেতর ঘর ।
ভেতর ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে তিনি। বয়স হয়েছে বুঝা যায় কিন্তু চিবুকে এখনো স্নিগ্ধতা ও আভিজাত্যের মিশেল । বেশ ঘরোয়া কিন্তু দামী শাড়ী জড়ানো গায়ে । কোন কোন মুখ দেখলে সাদা-কালো এলবামের ধ্রুপদী ছবি মনে হয় । এ মুখ সেরকম ।
তাঁর চোখে কৌতুহল,ঠোঁটে চাপা হাসি ।
-টেলিফোনে গলা শুনে আপনাকে আরো বয়স্ক মনে হচ্ছিলো ।
আমি হাসি । সবিনয়ে বলি-
-আমাকে তুমি করে বললে খুশী হবো ।
-ঠিকাছে, ভিতরে এসো ।

আমরা ভেতরে যাই।কাজের লোকটা অন্য কোথাও চলে গেছে।এই ঘরে শুধু তিনি এবং আমি। বেতের সোফায় বসি।পাশের সোফায় বসতে বসতে তিনিই কথা শুরু করেন-
-আমি কিন্তু তোমাকে ঠিক চিনতে পারিনি ।

নাম শুনে চিনে ফেলা অসম্ভব জেনেই আমি আমার নামটা বলি । তারপর বলি
-আমি ঢাকা থেকে এসেছি । সিনেমা বানাই
-ওহ । শুটিং করতে এসেছো? আমাদের ছোটবেলায় এখানে কতো শুটিং হতো । এখন মনে হয় সেরকম হয়না ।
-আমি ঠিক ওরকম সিনেমা বানাইনা । ডকুমেন্টারী করি ।
-আচ্ছা!

টের পাই-আমার সামনে যিনি বসে আছেন-এই শহরের সরকারী বালিকা বিদ্যালয়ের অবসর নেয়া প্রধান শিক্ষিকা,যার স্বামী বছর কয়েক আগে প্রয়াত, ছেলে মেয়েরা লন্ডন ও নিউইয়র্কে সেটেলড, নিজে ও বছরের বেশীর ভাগ সময় এখন বাইরে থাকেন- তার ভেতর আমাকে নিয়ে যুগপৎ কৌতুহল ও অস্বস্তি কাজ করছে ।
আমাদের মধ্যে ছেঁড়া ছেঁড়া কথা হয়
-আমি গত সপ্তাহে লন্ডন থেকে ফিরেছি । এতো ঠান্ডা পড়েছে এবার । ভাল্লাগেনা থাকতে ।
-আমি জানি ।
-জানো?
-জ্বি । আপনার ফেরার অপেক্ষায় ছিলাম । ফিরেছেন জেনেই আমি এসেছি ।

এবার তিনি স্পষ্ট করে আমার দিকে তাকান । কন্ঠ একটু ও না কাঁপিয়ে বলেন
-ঠিক কি কাজে তুমি এসেছো, বলোতো?

আমি বুকের একটু গভীরে বাতাস টেনে নেই । ধীরে ধীরে নিঃশ্বাস নিতে নিতে বলি
-একটা ডকু ফিল্ম বানাতে যাচ্ছি । আপনার সাহায্য দরকার । ইনফ্যাক্ট আপনার সাহায্য ছাড়া আমি পারবোনা । সেজন্য আপনার লন্ডন থেকে ফেরার অপেক্ষায় ছিলাম ।

তিনি হেসে উঠেন
-তোমার ফিল্ম বানাতে আমি সাহায্য করবো? কি সাহায্য করবো বলোতো? নানী-দাদীর ক্যারেক্টার করতে হবে? আমি জীবনে ও অভিনয় করিনি ।
তার হাসিতে আমি ও হাসি
-৩০ বছর আগে জন্ম নিলে আপনাকে আমার ফিল্মের নায়িকা বানাতাম
এবার আমরা দুজনেই একসাথে হেসে উঠি ।

হাসির রেশ থামার আগেই আমি জরুরী কথাটা বলে ফেলি
-একসময়ের বিখ্যাত একজন কবি’কে নিয়ে আমি ফিল্ম করতে চাচ্ছি । তার জীবনের জরুরী কিছু বিষয় আপনার সাথে জড়িত । এ গুলো আমার জানা দরকার ।
খুব স্থির কন্ঠে তিনি বলেন
-কার কথা বলছো তুমি?
-কবি রায়হান মুস্তাফিজ ।
-তুমি কে?
-আমি তার ছেলে ।

তিনি আর্তনাদের মতো আমার অগ্রজের ডাক নাম উচ্চারন করেন ।
-ও আমার বড় । খুব ছোটবেলায় আপনি ওকে দেখেছেন । আমার জন্ম তার পরে । আমরা তখন এ শহর ছেড়ে চলে গেছি ।


কাজের লোক ট্রলি ভর্তি নাস্তা নিয়ে ঢুকে । আমাদের কথায় স্তব্দতা নেমে আসে । তিনি আমাকে গাজরের হালুয়া এগিয়ে দেন । আমি নাড়াচাড়া করতে থাকি ।
কাজের লোক বেরিয়ে গেলে তিনিই আবার কথা শুরু করেন
-তোমার বাবা আমার কথা বলেছে?
-না । মা ।
- ও । কেমন আছেন তিনি?
-মা মারা গেছেন চার বছর আগে ।
- আমি দুঃখিত ।
-না ঠিকাছে । মারা যাওয়ার আগের দুবছর মা বিছানায় পড়েছিলেন । বড় ভাই কানাডায় চলে গেছে । বাবা ও তার মতো সময় কাটাতো । একমাত্র আমি মায়ের পাশে বসে থাকতাম । সেই সময়ে প্রথম আপনার কথা শুনি । মা অনেক গল্প করতো আপনার ।
-তোমার মা খুব ভালো ছিলেন ।
-আপনার তো বান্ধবী ছিলেন ।
-এক সাথে পড়েছি ।

কথা আবার থমকে যায় । তিনি বাবার কথা জিজ্ঞেস করেননা । তার জানতে ইচ্ছে করেনা নাকি অস্বস্তি?
-মায়ের মৃত্যুর পর বাবা ও চলে গেছে বড়ভাই এর কাছে । কিডনীর সমস্যায় ভুগছে ।
-ও
-বাবার সাথে আমার কখনোই তেমন ঘনিষ্ঠতা হয়নি । মা বিছানায় শুয়ে শুয়ে এতো গল্প করতো মানুষটাকে নিয়ে, পরে মনে হলো তাকে নিয়ে একটা ফিল্ম করা যায় ।
-তোমার মায়ের কাছে আর কি শুনেছো?
-বাবা এবং আপনার দীর্ঘসম্পর্ক ছিলো । আপনি চমৎকার গান গাইতেন আর কবি হিসেবে বাবার খ্যাতি ও ছড়াতে শুরু করেছে, সাথে ভালো চাকরী । প্রথম দিকে কিছুটা আপত্তি থাকলে ও শেষপর্যন্ত দু পরিবারের সম্মতি ছিলো । ছোট্ট মফস্বল শহরে আপনারা ছিলেন আদর্শ জুটি । কিন্তু…
-শেষ পর্যন্ত আমাদের বিয়ে হয়নি ।
-ঠিক এই বিষয়টাই আমি জানতে চাইছিলাম ।
-কেনো তোমার মা তোমাকে বলে যাননি?

আভিজাত্য ও স্নিগ্ধতা জড়ানো কন্ঠে তার এই প্রথম আমি কিছুটা শ্লেষের ইংগিত পাই ।
-না । এটা মায়ের কাছে ও রহস্য ছিলো ।
-তিনি তোমার বাবার বিবাহিত স্ত্রী ছিলেন ।
-মা আপনার বান্ধবী ছিলেন
-আমরা একসাথে পড়েছি ।
-যাইহোক । আপনি তো জানতেন তাকে । অতোটা সপ্রতিভ কখনোই ছিলেন না । নিজের ভেতর গুটিয়ে থাকতেন । বাবার সাথে ও তাকে আমরা খুব বেশী কথাবার্তা বলতে দেখিনি ।
-কিন্তু তোমার বাবা তো তাকেই বিয়ে করেছিলেন
-হ্যাঁ । আমার মায়ের কাছে ও এটা শেষদিন পর্যন্ত রহস্য ছিলো বাবা কেনো শেষপর্যন্ত তাকে বিয়ে করেছিলেন ।
-তাই নাকি? ভালো ।

আমি টের পাই একটা জটিলতা স্পর্শ করছে তাকে । আমি যা জানতে চাইছি তার বদলে কথাবার্তা চলে যাচ্ছে একজন প্রয়াত ও দুজন প্রায় বৃদ্ধ মানুষের বিগত যৌবনের হিসেব-নিকেশে । এখানে দাঁড়িয়ে আমি কার প্রতিনিধিত্ব করছি ? আমার মৃত নিস্প্রভ মায়ের,মৃত্যুর মুহুর্ত পর্যন্ত গুনী স্বামীর প্রতি যার অগাধ মুগ্ধতা ছিলো নাকি আমার সংস্পর্শহীন বাবার যাকে আমাদের কোনদিন তেমন করে বুঝে উঠা হয়নি ?
কিন্তু আমি তো এসব থেকে নিজেকে আলাদা রেখে প্রফেশনালী কিছু তথ্য জানতে চাই শুধু ।

আমি সমস্ত অস্বস্তি ঝেড়ে ফেলে এবার সরাসরি তাকে জিজ্ঞেস করি
-কবি রায়হান মুস্তাফিজের সাথে শেষপর্যন্ত আপনার বিয়েটা হলোনা কেনো? আমার ফিল্মের জন্য এই তথ্যটা জরুরী । প্লিজ আপনি ইজিলি আমাকে বলেন, সমস্ত প্রস্তুতি শেষে ও কেনো রায়হান মুস্তাফিজ বিয়েটা ভেংগে দিলেন ?

ঢং করে আওয়াজ দিয়ে না উঠলে আমি খেয়ালই করতাম না ঘরের দেয়ালে একটা বিশাল ঘড়ি । তার পেন্ডুলাম দুলছে ।
ঠোঁট কামড়ে তিনি উঠে দাঁড়ালেন । তার মুখের রঙ এতোটা সাদা আগে খেয়াল করিনি ।
-আছরের ওয়াক্ত হয়েছে, আমি নামাজ পড়তে যাচ্ছি । তুমি নাস্তাটা শেষ করে যেও ।



তিনি তার সমস্ত আভিজাত্য ও স্নিগ্ধতা নিয়ে চলে গেলে আমি স্থির দাঁড়িয়ে থাকি । পুরনো দিনের বিশাল দেয়াল ঘড়ির কাটাগুলো টিক টিক করে । বছর পঁয়ত্রিশ আগের সদ্য তরুনীকে আমার দেখতে ইচ্ছে জাগে । মফস্বল শহরের তার সৌন্দর্য্য রুপকথার মতো ছড়িয়ে বেড়াতো । মৃত্যুশয্যায় শুয়ে শুয়ে ও আমার মা সেই গল্প বলতেন । তার বলায় কোন হিংসা ছিলোনা । স্বামীর সাবেক প্রেমিকার জন্য তার নিজের ও মুগ্ধতা ছিলো । নাকি এই প্রসিদ্ধ সৌন্দর্য্যকে অস্বীকার করে বাবা তাকেই বিয়ে করেছিলেন বলে আমার অপ্রতিভ, গুরুত্বহীন মায়ের গোপন অহংকার ছিলো?

বাবা লোকটা চিরদিন আমার কাছে বিরক্তিকর এক রহস্য থেকে গেলো । আমি তার মতো এতোটা নির্মোহ, নিমগ্ন অথচ অন্যদের কাছে গুরুত্বপূর্ন হয়ে উঠতে পারলাম না । মায়ের প্রতি তার কোন মনোযোগ ছিলোনা তবু মায়ের কি অসীম মুগ্ধতা ছিলো এই মানুষটার জন্য। দীর্ঘ সম্পর্কের পরিনতিতে বিয়ের সমস্ত আয়োজন শেষে যে প্রেমিক অস্বীকৃতি জানায় তার জন্য ও এই ধ্রুপদী সুন্দরীর এতো অভিমান?
লোকটাকে আমার অসহ্য ঠেকে ।

-তোমার বাবার বিরহের শখ জেগেছিলো । তার কবিত্বের পূর্নতার জন্য নাকি ওটা জরুরী ছিলো
আমি ঘাড় ঘুরিয়ে তাকে দেখি । তিনি ভেতরের সিঁড়ি ভেংগে নেমে এসেছেন আবার । এবার তাকে অনেকটা স্থির দেখাচ্ছে,যদি ও চোখ দুটো লাল হয়ে আছে ।
-জ্বি!
-হ্যাঁ, তুমি তো এটাই জানতে চেয়েছিলে । বড় কবি হওয়ার লোভে তোমার বাবা আমাকে বিয়ে করেননি । তিনি বড় কবি হয়েছেন ।
-ও
আমি কোন ভাষা খুঁজে পাইনা ।
-আমাদের যেদিন আনুষ্ঠানিক ভাবে বিয়ের দিনতারিখ ঠিক হবার কথা সেদিনই তিনি আমাকে জানিয়েছিলেন, কবি হওয়ার জন্য তার বিরহের অভিজ্ঞতা খুব জরুরী । যেনো আমি তাকে সেই অভিজ্ঞতা দান করি । তোমাকে বাবাকে আমি বড় কবি হবার জন্য বিরহ দান করেছিলাম

আমার কাছে সবকিছু পাজলের মতো লাগে । তার দিকে আমি চোখ তুলে তাকাতে পারিনা । যেনো রোমান সম্রাজ্ঞীর দারুন গরিমা নিয়ে তিনি এক কবিযশপ্রার্থী অপরিপক্ক তরুনকে মৃত্যুদন্ড দান করছেন ।
এই গরিমা, তার কন্ঠের তেজ আমার কাছে অসহ্য লাগে ।
-তোমার সিনেমাটা বানানো হলে আমাকে জানিও । বহুদিন সিনেমা দেখিনি । কি নাম দেবে সিনেমার?

বাহ। মুহুর্তের মধ্যে আমি আমার না বানানো সিনেমার নাম খুঁজে পাই । এই নামই হবে গরিমাময়ী সম্রাজ্ঞীর বিরুদ্ধে আমার সামান্য অস্ত্র ।
- সিনেমার নাম হবে ‘কবি ও প্রেমিকা গন’
-প্রেমিকা গন ! ‘গন’ কেনো?

আমার অস্ত্র তবে একেবারে ভোঁতা নয় । তারদিকে আর না তাকিয়ে বাইরে দরজার দিকে পা বাড়িয়ে বলি
-কারন কেবল আপনিই কবি রায়হান মুস্তাফিজ এর একমাত্র প্রেমিকা ছিলেন না ।

আমি তার দিকে তাকাইনা আর ।
কিন্তু তার নিচু কন্ঠের স্পষ্ট উচ্চারন শুনি
-তুমি তোমার বাবার মতোই হয়েছো ।

সম্রাজ্ঞীর আহত কন্ঠ কেমন গোঙ্গানীর মতো শোনায় । বেদনাহত । আমি চোখ নিচু করি ।
কোন কোন দূরত্ব এতো অনতিক্রম্য হয়ে উঠে কেনো?


[ লিখেছিলাম সচলায়তনে মার্চ ২০০৯]

যাপনচাতুর্য

আমার ছোট্ট ফ্লাটের বারান্দায় দাঁড়িয়ে সকালটা দেখতে বেশ ভালোই লাগছিলো । এই ফ্লাটে উঠেছি মাসছয়েক । কেনা নয় অবশ্য,ভাড়া ।পছন্দ-অপছন্দে আমি ততোটা চৌকস নয়-তা সে বৌ কিংবা ফ্লাটই হোক ।রিনি’র ভালো লেগেছে-এটাই যথেষ্ট ।
ছুটিরদিনের সকালবেলা ঘুম না ভাংগলে ও চলে কিন্তু ছুটিরদিনেই আমার ঘুম ভেংগে যায় সকালবেলা,বরং রিনি বেশ বেলা করে জাগে । আমি ওকে ঘুমোতে দেই,ঘুমোক বেচারী । এককাপ চা করে প্রায়ই এসে দাঁড়াই এই বারান্দায় ।
প্রথম প্রথম অনেকদূর পর্যন্ত দেখতে পেতাম ।রাস্তার উলটো দিকে একটা নারকেল গাছে ঘেরা টিনের বাড়ী । এক মধ্যবয়স্ক পুরুষ সকালবেলা তার ছেলেকে পড়াতে বসেন বারান্দায়, আমার দেখতে ভালো লাগে । এখন বাড়ীটার সামনে বহুতল এপার্টমেন্ট উঠছে,আমার দৃষ্টিসীমানা সংকুচিত হয়ে আসছে । এখনো সেই নারকেল গাছ ঘেরা টিনের বাড়ি,মধ্যবয়স্ক পুরুষের ঘর গেরস্থালী,সন্তানকে শিক্ষাদান দৃষ্টগোচর হয়, এপার্টমেন্ট পুরো হয়ে গেলে আর হয়তো দেখা হবেনা ।

মাসতিনেক আগে স্বাতী যখন ফ্লোরিডা থেকে এলো দেশে,আমাদের এই দু রুমের ফ্লাটে থেকেছিলো দুতিনদিন । রিনিই একরকম জোর করে ওকে নিয়ে এসেছিল । রিনি আর স্বাতী খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলো নিঃসন্দেহে ।
স্বাতী একটা চমৎকার দুরবীন এনেছিল আমার জন্য । আমার জন্য? না,স্বাতী আসলে আমার জন্য কিছু আনেনি ।আমি আর রিনি বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছিলাম , ও লাগেজ থেকে দুরবীনের বাক্সটা বের করে এন বলেছিল
-‘তোদের ছেলে হবে নিশ্চয়ই, ওর জন্য এটা’
আমরা খুব হেসেছিলাম । বিয়ের প্রায় পাঁচবছর,আমরা কোন সন্তান নেইনি এখনো ।

স্বাতীর দেয়া দূরবীনটা চোখে ধরলেই সেই নারিকেল গাছে ঘেরা বাড়ীটা আরো কাছে চলে আসে । মধ্যবয়স্ক লোকটা কাঠের চেয়ারে বসে,তার শিশুপুত্র বসে বেতের মোড়ায়,কোন কোন দিন দেখি ঘোমটা দেয়া এক মহিলা চা-মুড়ি এনে রাখে ওদের সামনে । শিশুটা শুকনো মুড়ি চিবোয়,লোকটা চায়ে ঢালে ।
দুরবীণ উলটো করে ধরলে আরো মজা হয়-কাছের রাস্তা,রিক্সা,এপার্টমেন্ট,মানুষজন অনেক দূরে সরে যায়,দূরে যেতে যেতে অনেক অনেক দুরে চলে যায় সবকিছু,অনেক পিছনে । অতো পেছনে গিয়ে আমি একটা চাবাগান ঘেরা টিলার উপর এসে দাঁড়াই,দাঁড়িয়ে আরো বহুদূর দেখার চেষ্টা করি ।
স্বাতী আমাকে জিজ্ঞেস করে-
কি দেখতে চাও অতোদূরে?
-আমি এখানে দাঁড়িয়ে সমুদ্র দেখতে চাই ।
-পাগল,এখানে সমুদ্র কোথায়?
-নেই হয়তো । কিন্তু আমার ইচ্ছে একটা জাহাজে চড়ে আমি গভীর সমুদ্রে যাবো , আমার হাতে একটা দূরবীন থাকবে । জাহাজের ডেকে দাঁড়িয়ে দুরবীন দিয়ে দেখবো আরো দুর দুর নীল সমুদ্র

আমার সমুদ্রযাত্রা হয়নি । স্বাতী আটলান্টিক পাড়ি দিয়ে ফ্লোরিডায় চলে গিয়েছিল ছয় বছর আগে ।
জোবায়ের গিয়েছিলো লন্ডনে,বিয়ে করে । স্বাতী আটলান্টিক পাড়ি না দিলে কিংবা জোবায়ের বিয়ে করে লন্ডন চলে না গেলে-বোধহয় আমার আর রিনির বিয়ে করা হতোনা ।
বোধ হয় কেনো? নিশ্চিতভাবেই হতোনা । এরকম কিছু হওয়ার কথা কিংবা ইংগিত ছিলোনা ।

অথচ আমি তখন উদ্ভ্রান্ত,রিনি ও ডানাভাংগা । আমাদের অপ্রাপ্তি,আমাদের দুজনের ভিন্ন ভিন্ন স্বপ্নের লাশই শেষ পর্যন্ত আমদেরকে কাছে নিয়ে এসেছিল । আমার ও তখন আর কেউ নেই, রিনি ও নিঃসংগ । দুজন পরাজিত মানুষ পরস্পরকে আঁকড়ে ধরেছিলাম ।
এখন কেবল ছুটিরদিনের সকালবেলা এইসব ভাবার অবসর পাই আমি,যখন রিনি ঘুমিয়ে থাকে । যতোক্ষন রিনি জেগে থাকে ততোক্ষন ও আমাকে সব ভুলিয়ে রাখে শরীর ও স্নেহ দিয়ে, আমি ও ওকে সব ভুলিয়ে রাখি সবকিছু মেনে নিয়ে । আমি ও রিনি ভালো থাকি,ভালোবাসি পরস্পরকে-মৃতপ্রায় মানুষ যেমন তার ক্ষয়ে যাওয়া জীবনকে । ও কখনো স্বাতীর প্রসংগ তোলেনা,আমি ও জোবায়েরকে মনে করিনা ।

স্বাতী আটলান্টিক পাড়ি দেয়ার পরের দিনগুলো আমার বিভীষিকার মতো কেটেছিলো, ওর জন্য আমার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসতো,আমার অনুভূতি আমাকে তীব্র আহত করতো । রিনি বদলে দিয়েছে সব,স্বাতীর জন্য আমার অনুভূতি ও বদলে গেছে এখন । এখন মাঝে মাঝে রিনির নগ্ন শরীরে আমি স্বাতীর মুখ বসিয়ে দিতে পারি,রিনির ভেতরে যখন প্রবেশ করি, মাঝে মাঝেই নির্দ্বিধায় চোখ বন্ধ করে শরীরের নিচে আমি স্বাতীকে আঁকড়ে ধরতে পারি । কষ্ট-টষ্ট কিছু নেই আর, আমার প্রবৃত্তি দিয়ে স্বাতীকে ছুঁয়ে ফেলতে পারি এখ্ আর গোপনে আমার বড় আনন্দ ও জাগে । আমার শরীরের নিচে শুয়ে নিরাভরন রিনি জোবায়ের পিঠেই তার নখ বসিয়ে দেয় কিনা,সে অবশ্য আমি কোনদিন জানতে চাইনি ।
স্বাতী বেড়াতে এলে আমরা খুব মজা করেছিলাম, স্বাতীর মেয়ের জন্য রিনি অনেকগুলো ড্রেস কিনেছিলো । বিশ্ববিদ্যালয়ের দিনগুলোর মতো আমরা তিনজন ঘুরে বেড়িয়েছি, আমরা জোবায়েরকে ও মিস করেছি । ও ব্যাটা এলে সেই পুরনো দিনের মতোই আবার আমরা চারজন ।
আজ রিনি ঘুম থেকে উঠলে আমরা এয়ারপোর্টে যাবো । কি এক জরুরী কাজে জোবায়ের ওর বৌ-ছেলেকে রেখে একাই আসছে লন্ডন থেকে,আমাদের ফ্লাটে উঠবে প্রথমে,তারপর ওর বাড়ি যাবে ।
আমার আর রিনির না জন্মানো ছেলের জন্য স্বাতী দুরবীন এনেছিল । আমার খুব আগ্রহ হচ্ছে আমাদের ভবিষ্যত মেয়ের জন্য জোবায়ের কি উপহার আনে?
আমাদের বিয়ের প্রায় পাঁচবছর হয়ে গেলো । ডাক্তার বলে দিয়েছে,আমাদের কোনদিন সন্তান হবেনা ।


[ লিখেছিলাম সচলায়তনে মার্চ ২০০৮]

আধূলী

শহর সিলেট এবার নগর হচ্ছে।
কীন ব্রীজ ছেড়ে চলে গেছে মিস্টিক কপোত-কপোতী।
চৌহাট্টার ছায়া ঢাকা পথ হবে এভিনিউ।
এক ক্ষ্যাপাটে হাস্যকর মন্ত্রীর অসুস্থ ফ্যান্টাসীর শিকার হবে দুপাশের কৃষ্ণচূড়া সব।

খুব দ্রুত ইট কাঠ পাথরের স্তুপে পরিণত হচ্ছে একদা ভীষণ প্রিয় এই শহর। অদ্ভুত উন্মাদনা প্রতিবেশে। ঘর-বসতি ভেঙে গড়ে উঠছে মার্কেট। সমস্ত দীঘি-জলাশয় বুজে দিয়ে মার্কেট। আর সকল মানুষ বদলে গিয়ে কেবলই ক্রেতা-বিক্রেতা।
ক্রেতারা আসে টেমস এর পাড় থেকে। যদিও সেখানে তারাই বিক্রেতা। শ্রম বিক্রী করে হোটেলে, রেষ্টুরেন্টে। কিন্তু সুরমা পাড়ে এসেই ভূমিকা বদলায়। পাউন্ড ভাংগিয়ে সুন্দরী বউ কেনে, শিক্ষিত বর কেনে, গাড়ী-গয়না, হেরোইন কেনে, মানুষের দীর্ঘশ্বাস কেনে।

আর বিক্রেতারা আসে ধরলা, করতোয়া, সোমেশ্বরী’র তীর থেকে। কেউ কার্তিকের মংগার গ্রাস, কেউ নদী ভাংগনের দীর্ঘশ্বাস- কেউ ফেরারী আসামী-এই রং লাগা, টাকা উড়া শহরে সবার এক ডাক নাম ‘আবাদী’। প্রায় অস্পৃশ্য, গালি-গালাজের মতউচ্চারিত এই শব্দের তকমা জড়িয়ে তারা নিজেদের বিক্রী করে। রিকশা টানে, পাথর ভাঙে, ‘কামলা’ খাটে।
আর এই ক্রেতা-বিক্রেতার ভীড়ে এই শহরের নিজস্ব মানুষ যারা চা-পাতার মত ঘন সবুজ, কমলা লেবুর মত ঘ্রানময়, তারা বিলুপ্ত ক্রমশ:। তারা হারিয়ে যাচ্ছে কীণ ব্রীজের কপোত কপোতীর মতো, এই শহরের বিখ্যাত সুন্দরের মত।

চৌহাট্টা পয়েন্ট থেকে রিকাবী বাজারের দিকে হাঁটতে হাঁটতে নিজেকে খুব একা আর অপ্রাসংগিক মনে হচ্ছিল হাসানের। এ শহরে এখন কোন বন্ধু নেই, এ শহরে এখন কোন প্রেমিকা নেই। এ শহরে পরম শত্রু হবার যোগ্য কোন মানুষও নেই। মানুষ নাকি প্রতি মুহূর্তে বদলায় নদীর জলের মতো, গভীর নিরিখ ছাড়া বদল বোঝা যায় না- কে যেন বলেছিল, এখন আর মনে পড়ে না। যাকে চেনা হয় তার একটা অংশ কেবল চেনা, বাকীটুকু নিজের মত করে বানিয়ে নেয়া আর বানানোটুকুকেই পরিচিত বলে মেনে নেবার মিথ্যে পস্টবোধ। দীর্ঘ সহবাসেও মানুষ থেকে যায় মানুষের চেনার অতীত।

রাস্তার পাশে একটা জটলা, ভিড়বে কি ভিড়বে না- ভাবনা শেষ হবার আগেই ভীড়ে যায় হাসান।
ঠেলাঠেলি পার হয়ে দেখতে পায়, এক প্রায় বৃদ্ধ চিৎপাত-
‘কিতা ব্যাফার, কিতা অইছে’-কেউ জানেনা।
জটলার পাশে একটা খালি রিকসা।

চিত্রনাট্য বুঝে নিতে দেরী হয় না হাসানের। ধরলা করতোয়ার করাল গ্রাসে বসত বাটি বিলিয়ে দিয়ে , আজীবন ভূমিপুত্রদের একটা বড় অংশ এসে এই শহরে ‘রিকসাওয়ালা’ হয়। 'হালার হালা আবাদী' হয়। লাঙ্গল ধরা হাতে রিথার হ্যান্ডেল ধরে। টাকা পয়সা যা কামায় তাতে অন্তত: বেঁচে থাকে কিন্তু এই শহরের লোকদের কথা তারা বুঝে না। বাচ্চা বাচ্চা ছেলেরাও তুই তোকারী করে, কথা না বোঝলে চড় থাপ্পর মারে, কখনো কখনো তার থেকেও বেশী।
জুলাইয়ের প্রচন্ড দুপুরে র্রিক্সা টানতে না চাওয়ার অপরাধে এই শহরে পিটিয়ে মেরে ফেলা হয়েছে এক ‘হালার হালা রিক্সা ওয়ালা’কে। এই সেই শহর যেখানে ধর্মের জিকির উঠে সব থেকে বেশী।

কিন্তু হাসান ধর্মের ঢেকুর তুলে না বলে, এই বণিক শহরের একজন হয়েও ক্রেতা হয়ে উঠেনি বলে, বিকলাঙ্গ ভীড় ঠেলে ভেতরে ঢুকে।
রথাথ অচেতন শরীরটাকে কোলে তোলে নেয়।
বাকীরা সার্কাস দেখে বিনে পয়সায়।


[২]
-রোগীর নাম বলেন।
- নাম তো জানিনা।
- জানেন না মানে? নিজের রুগীর না জানেন না, মানে কি?
- আরে ভাই, রোগী তো আমার কেউ না। রাস্তায় পড়েছিল- তাই...
- তাই কি? এখানে নিয়ে এলেন? থানায় খবর দিয়েছেন? যদি কিছু হয়ে যায় রিস্ক কে নেবে- আপনি?
হাসান থমকে যায়। এতো মহাযন্ত্রণা। একটা মানুষ মরতে বসছে। তবু হাসপাতালের বদলে যেতে হবে থানায়? পুলিশ কি করবে? মেরে ফেলা ছাড়া তো কাউকে বাঁচিয়ে তোলার ইতিহাস পুলিশের নেই ।

‘আরে হাসান বাই, কিতা খবর?’ প্রায় ফেরেশতার মত এসে দাঁড়ায় ছেলেটা। এক পুরনো বন্ধুর ছোট ভাই। মনে হয় ইন্টার্নী করছে। হাসান তার হাত ধরে সব কিছু বুঝিয়ে বলে। ছেলেটা এখনো ডাক্তার হয়নি বলে কসাই হয়ে উঠেনি। খুব দ্রুত সে সব কিছু ম্যানেজ করে, ইমার্জেন্সী থেকে করিয়ে নিয়ে আসে জেনারেল ওয়ার্ডে। বিশ্রী দুর্গন্ধ । তবু সৌভাগ্যের মত দুর্লভ একটা বেড ও ম্যানেজ হয়।

বসে থাকে হাসান। লোকটার এখনো জ্ঞান ফেরেনি। এবড়ো থেবেড়ো চেহারা। বাংলাদেশের মানচিত্রের মতো । এই সুরমা পাড়ের যারা টেমস পাড়েযায় শ্রম বিক্রি করতে তারাও তো এই লোকটার মতোই। তারাও কি ওখানে এরকম নতজানু, অসহায়, আক্রান্ত ’? তাহলে এই শহরের মানুষেরা এই সব নদীভাঙ্গা সরল মানুষদের সহমর্মী হয় না কেন?
নাকি টেমস পাড়ের অসহায়ত্ব-বিকৃত আভিজাত্য আর আক্রোশ হয়ে প্রকাশ পায় সুরমা তীরে? তাহলে কি এই আক্রান্ত লোকটাও দুচার হাজার টাকা জমিয়ে যখন ফিরে যাবে তার ধরলা করতোয়ার নিরণ্ণ জনপদে, তখন সেও একই রকম মেকী অভিজাত ও নিষ্ঠুর হয়ে উঠবে?

ভাবনার সুতো ছিঁড়ে কফিনের কাপড় মোড়ানো এক কুৎসিত নার্স। কর্কশ সুরে প্রায় চিৎকার করে উঠে।
-এই ওষুধগুলো লাগবে। নিয়ে আসেন।
-কেন, হাসপাতালে ঔষধ নেই? বলা হয় না।
-রাতে রোগীর সাথে কে থাকবে?
-‘কেন? আপনারই তো থাকার কথা
না এই কথাও বলা হয় না।
ঔষধের তালিকা হাতে নিয়ে বাইরে বেরুতেই নিকষ অন্ধকার। কখন যে রাত নেমে এসেছে। সিঁড়ি হাতড়ে নিচে নামতে নামতে এক পাশে মহিলা ওয়ার্ড। দরজার পাশে মেঝেতে শুয়ে এক যুবতী ছটফট করছে প্র সব বেদনায়।
পাশে কেউ নেই।
না ডাক্তর, না নার্স, না ঈশ্বর।


[৩]
হাসপাতাল ক্যান্টিনের ঠান্ডা সিংগারায় কামড় বসায় হাসান।
চড়া স্বরে বাজছে হিন্দী সিনেমার গান- ‘তেরে নাম’। গানের সুরটা খুব সুন্দর। ওদের সব সুন্দর। গান সুন্দর, গায়িকা সুন্দর, নায়িকা সুন্দর, পোষক সুন্দর, পণ্য সুন্দর। আর এই সব সুন্দর সর্বনাশ গ্রাস করে নিচ্ছে সমস্ত আবহ। হাসান দিন গোনে আরেকটা ৫২’র। কিন্তু ভরসা পায় না তেমন।
যদিও প্রবল প্র তিরোধের মুখে কানকুনে ভেংগে গেছে বিশ্ব বণিক সমিতির ষড়যন্ত্র সম্মেলন। কিন্তু সভ্যতার নামে শেষ পর্যন্ত শুয়োরের বাচ্চারাই জিতে যাবে।

নিজস্ব বলে কিছু থাকবে না কোন রাষ্ট্রের। রাষ্ট্র আর ভর্তুকী দেবেন শিক্ষা, চিকিৎসা, কৃষিতে। বীজের দাম বাড়বে, সারের দাম আকাশ ছোঁয়া, হাসপাতাল ঔষধ শূন্য। ধরলা, করতোয়া, ব্রম্মপুত্র পাড়ের মানুষ আরো বেশী নিরণ্ণ হবে- ‘কামলা’ হবে। বিশমাতব্বরেরা ফসলের স্থান নির্ধারণ করে দেবে দেশে দেশে। সমস্ত খাদ্য শস্য উৎপাদন হবে টেক্সাস এর বিশাল প্রান্তরে। আর এই দরিদ্র রাষ্ট্র তবে কী উৎপাদনের সুযোগ পাবে? তামাক আর পপি ফুল?
বাসি সিঙ্গারার ঠান্ডা ছড়িয়ে পড়ে হাসানের সমস্ত শরীর ও স্বত্বায় ।
হাসপাতালের বেডে যে শুয়ে আছে যে বিগত প্রায়- কোথায় যাচ্ছে ?
হাসান দাঁড়িয়ে আছে বর্তমানে- কোথায় আছে?
মহিলা ওয়ার্ডের নোংরা মেঝেতে শুয়ে থাকা মায়ের গর্ভ থেকে যে আসছে, সে-কোথায় আসছে?

মাথার ভেতর আরো ঘন হয়ে আসে কুয়াশা।
ক্যাসেট প্লেয়ার এ এবার কন্ঠ বদলায়।
‘তেরে নাম’ এর বদলে সাঈদীর আওয়াজ।
আরো সুন্দর, আরো সুরেলা।
আরো সর্বনাশ।

[ লেখা হয়েছিল ২০০৪ এর প্রথম দিকে ]