Tuesday, May 05, 2009

আধূলী

শহর সিলেট এবার নগর হচ্ছে।
কীন ব্রীজ ছেড়ে চলে গেছে মিস্টিক কপোত-কপোতী।
চৌহাট্টার ছায়া ঢাকা পথ হবে এভিনিউ।
এক ক্ষ্যাপাটে হাস্যকর মন্ত্রীর অসুস্থ ফ্যান্টাসীর শিকার হবে দুপাশের কৃষ্ণচূড়া সব।

খুব দ্রুত ইট কাঠ পাথরের স্তুপে পরিণত হচ্ছে একদা ভীষণ প্রিয় এই শহর। অদ্ভুত উন্মাদনা প্রতিবেশে। ঘর-বসতি ভেঙে গড়ে উঠছে মার্কেট। সমস্ত দীঘি-জলাশয় বুজে দিয়ে মার্কেট। আর সকল মানুষ বদলে গিয়ে কেবলই ক্রেতা-বিক্রেতা।
ক্রেতারা আসে টেমস এর পাড় থেকে। যদিও সেখানে তারাই বিক্রেতা। শ্রম বিক্রী করে হোটেলে, রেষ্টুরেন্টে। কিন্তু সুরমা পাড়ে এসেই ভূমিকা বদলায়। পাউন্ড ভাংগিয়ে সুন্দরী বউ কেনে, শিক্ষিত বর কেনে, গাড়ী-গয়না, হেরোইন কেনে, মানুষের দীর্ঘশ্বাস কেনে।

আর বিক্রেতারা আসে ধরলা, করতোয়া, সোমেশ্বরী’র তীর থেকে। কেউ কার্তিকের মংগার গ্রাস, কেউ নদী ভাংগনের দীর্ঘশ্বাস- কেউ ফেরারী আসামী-এই রং লাগা, টাকা উড়া শহরে সবার এক ডাক নাম ‘আবাদী’। প্রায় অস্পৃশ্য, গালি-গালাজের মতউচ্চারিত এই শব্দের তকমা জড়িয়ে তারা নিজেদের বিক্রী করে। রিকশা টানে, পাথর ভাঙে, ‘কামলা’ খাটে।
আর এই ক্রেতা-বিক্রেতার ভীড়ে এই শহরের নিজস্ব মানুষ যারা চা-পাতার মত ঘন সবুজ, কমলা লেবুর মত ঘ্রানময়, তারা বিলুপ্ত ক্রমশ:। তারা হারিয়ে যাচ্ছে কীণ ব্রীজের কপোত কপোতীর মতো, এই শহরের বিখ্যাত সুন্দরের মত।

চৌহাট্টা পয়েন্ট থেকে রিকাবী বাজারের দিকে হাঁটতে হাঁটতে নিজেকে খুব একা আর অপ্রাসংগিক মনে হচ্ছিল হাসানের। এ শহরে এখন কোন বন্ধু নেই, এ শহরে এখন কোন প্রেমিকা নেই। এ শহরে পরম শত্রু হবার যোগ্য কোন মানুষও নেই। মানুষ নাকি প্রতি মুহূর্তে বদলায় নদীর জলের মতো, গভীর নিরিখ ছাড়া বদল বোঝা যায় না- কে যেন বলেছিল, এখন আর মনে পড়ে না। যাকে চেনা হয় তার একটা অংশ কেবল চেনা, বাকীটুকু নিজের মত করে বানিয়ে নেয়া আর বানানোটুকুকেই পরিচিত বলে মেনে নেবার মিথ্যে পস্টবোধ। দীর্ঘ সহবাসেও মানুষ থেকে যায় মানুষের চেনার অতীত।

রাস্তার পাশে একটা জটলা, ভিড়বে কি ভিড়বে না- ভাবনা শেষ হবার আগেই ভীড়ে যায় হাসান।
ঠেলাঠেলি পার হয়ে দেখতে পায়, এক প্রায় বৃদ্ধ চিৎপাত-
‘কিতা ব্যাফার, কিতা অইছে’-কেউ জানেনা।
জটলার পাশে একটা খালি রিকসা।

চিত্রনাট্য বুঝে নিতে দেরী হয় না হাসানের। ধরলা করতোয়ার করাল গ্রাসে বসত বাটি বিলিয়ে দিয়ে , আজীবন ভূমিপুত্রদের একটা বড় অংশ এসে এই শহরে ‘রিকসাওয়ালা’ হয়। 'হালার হালা আবাদী' হয়। লাঙ্গল ধরা হাতে রিথার হ্যান্ডেল ধরে। টাকা পয়সা যা কামায় তাতে অন্তত: বেঁচে থাকে কিন্তু এই শহরের লোকদের কথা তারা বুঝে না। বাচ্চা বাচ্চা ছেলেরাও তুই তোকারী করে, কথা না বোঝলে চড় থাপ্পর মারে, কখনো কখনো তার থেকেও বেশী।
জুলাইয়ের প্রচন্ড দুপুরে র্রিক্সা টানতে না চাওয়ার অপরাধে এই শহরে পিটিয়ে মেরে ফেলা হয়েছে এক ‘হালার হালা রিক্সা ওয়ালা’কে। এই সেই শহর যেখানে ধর্মের জিকির উঠে সব থেকে বেশী।

কিন্তু হাসান ধর্মের ঢেকুর তুলে না বলে, এই বণিক শহরের একজন হয়েও ক্রেতা হয়ে উঠেনি বলে, বিকলাঙ্গ ভীড় ঠেলে ভেতরে ঢুকে।
রথাথ অচেতন শরীরটাকে কোলে তোলে নেয়।
বাকীরা সার্কাস দেখে বিনে পয়সায়।


[২]
-রোগীর নাম বলেন।
- নাম তো জানিনা।
- জানেন না মানে? নিজের রুগীর না জানেন না, মানে কি?
- আরে ভাই, রোগী তো আমার কেউ না। রাস্তায় পড়েছিল- তাই...
- তাই কি? এখানে নিয়ে এলেন? থানায় খবর দিয়েছেন? যদি কিছু হয়ে যায় রিস্ক কে নেবে- আপনি?
হাসান থমকে যায়। এতো মহাযন্ত্রণা। একটা মানুষ মরতে বসছে। তবু হাসপাতালের বদলে যেতে হবে থানায়? পুলিশ কি করবে? মেরে ফেলা ছাড়া তো কাউকে বাঁচিয়ে তোলার ইতিহাস পুলিশের নেই ।

‘আরে হাসান বাই, কিতা খবর?’ প্রায় ফেরেশতার মত এসে দাঁড়ায় ছেলেটা। এক পুরনো বন্ধুর ছোট ভাই। মনে হয় ইন্টার্নী করছে। হাসান তার হাত ধরে সব কিছু বুঝিয়ে বলে। ছেলেটা এখনো ডাক্তার হয়নি বলে কসাই হয়ে উঠেনি। খুব দ্রুত সে সব কিছু ম্যানেজ করে, ইমার্জেন্সী থেকে করিয়ে নিয়ে আসে জেনারেল ওয়ার্ডে। বিশ্রী দুর্গন্ধ । তবু সৌভাগ্যের মত দুর্লভ একটা বেড ও ম্যানেজ হয়।

বসে থাকে হাসান। লোকটার এখনো জ্ঞান ফেরেনি। এবড়ো থেবেড়ো চেহারা। বাংলাদেশের মানচিত্রের মতো । এই সুরমা পাড়ের যারা টেমস পাড়েযায় শ্রম বিক্রি করতে তারাও তো এই লোকটার মতোই। তারাও কি ওখানে এরকম নতজানু, অসহায়, আক্রান্ত ’? তাহলে এই শহরের মানুষেরা এই সব নদীভাঙ্গা সরল মানুষদের সহমর্মী হয় না কেন?
নাকি টেমস পাড়ের অসহায়ত্ব-বিকৃত আভিজাত্য আর আক্রোশ হয়ে প্রকাশ পায় সুরমা তীরে? তাহলে কি এই আক্রান্ত লোকটাও দুচার হাজার টাকা জমিয়ে যখন ফিরে যাবে তার ধরলা করতোয়ার নিরণ্ণ জনপদে, তখন সেও একই রকম মেকী অভিজাত ও নিষ্ঠুর হয়ে উঠবে?

ভাবনার সুতো ছিঁড়ে কফিনের কাপড় মোড়ানো এক কুৎসিত নার্স। কর্কশ সুরে প্রায় চিৎকার করে উঠে।
-এই ওষুধগুলো লাগবে। নিয়ে আসেন।
-কেন, হাসপাতালে ঔষধ নেই? বলা হয় না।
-রাতে রোগীর সাথে কে থাকবে?
-‘কেন? আপনারই তো থাকার কথা
না এই কথাও বলা হয় না।
ঔষধের তালিকা হাতে নিয়ে বাইরে বেরুতেই নিকষ অন্ধকার। কখন যে রাত নেমে এসেছে। সিঁড়ি হাতড়ে নিচে নামতে নামতে এক পাশে মহিলা ওয়ার্ড। দরজার পাশে মেঝেতে শুয়ে এক যুবতী ছটফট করছে প্র সব বেদনায়।
পাশে কেউ নেই।
না ডাক্তর, না নার্স, না ঈশ্বর।


[৩]
হাসপাতাল ক্যান্টিনের ঠান্ডা সিংগারায় কামড় বসায় হাসান।
চড়া স্বরে বাজছে হিন্দী সিনেমার গান- ‘তেরে নাম’। গানের সুরটা খুব সুন্দর। ওদের সব সুন্দর। গান সুন্দর, গায়িকা সুন্দর, নায়িকা সুন্দর, পোষক সুন্দর, পণ্য সুন্দর। আর এই সব সুন্দর সর্বনাশ গ্রাস করে নিচ্ছে সমস্ত আবহ। হাসান দিন গোনে আরেকটা ৫২’র। কিন্তু ভরসা পায় না তেমন।
যদিও প্রবল প্র তিরোধের মুখে কানকুনে ভেংগে গেছে বিশ্ব বণিক সমিতির ষড়যন্ত্র সম্মেলন। কিন্তু সভ্যতার নামে শেষ পর্যন্ত শুয়োরের বাচ্চারাই জিতে যাবে।

নিজস্ব বলে কিছু থাকবে না কোন রাষ্ট্রের। রাষ্ট্র আর ভর্তুকী দেবেন শিক্ষা, চিকিৎসা, কৃষিতে। বীজের দাম বাড়বে, সারের দাম আকাশ ছোঁয়া, হাসপাতাল ঔষধ শূন্য। ধরলা, করতোয়া, ব্রম্মপুত্র পাড়ের মানুষ আরো বেশী নিরণ্ণ হবে- ‘কামলা’ হবে। বিশমাতব্বরেরা ফসলের স্থান নির্ধারণ করে দেবে দেশে দেশে। সমস্ত খাদ্য শস্য উৎপাদন হবে টেক্সাস এর বিশাল প্রান্তরে। আর এই দরিদ্র রাষ্ট্র তবে কী উৎপাদনের সুযোগ পাবে? তামাক আর পপি ফুল?
বাসি সিঙ্গারার ঠান্ডা ছড়িয়ে পড়ে হাসানের সমস্ত শরীর ও স্বত্বায় ।
হাসপাতালের বেডে যে শুয়ে আছে যে বিগত প্রায়- কোথায় যাচ্ছে ?
হাসান দাঁড়িয়ে আছে বর্তমানে- কোথায় আছে?
মহিলা ওয়ার্ডের নোংরা মেঝেতে শুয়ে থাকা মায়ের গর্ভ থেকে যে আসছে, সে-কোথায় আসছে?

মাথার ভেতর আরো ঘন হয়ে আসে কুয়াশা।
ক্যাসেট প্লেয়ার এ এবার কন্ঠ বদলায়।
‘তেরে নাম’ এর বদলে সাঈদীর আওয়াজ।
আরো সুন্দর, আরো সুরেলা।
আরো সর্বনাশ।

[ লেখা হয়েছিল ২০০৪ এর প্রথম দিকে ]

No comments: