Tuesday, May 05, 2009

যাপনচাতুর্য

আমার ছোট্ট ফ্লাটের বারান্দায় দাঁড়িয়ে সকালটা দেখতে বেশ ভালোই লাগছিলো । এই ফ্লাটে উঠেছি মাসছয়েক । কেনা নয় অবশ্য,ভাড়া ।পছন্দ-অপছন্দে আমি ততোটা চৌকস নয়-তা সে বৌ কিংবা ফ্লাটই হোক ।রিনি’র ভালো লেগেছে-এটাই যথেষ্ট ।
ছুটিরদিনের সকালবেলা ঘুম না ভাংগলে ও চলে কিন্তু ছুটিরদিনেই আমার ঘুম ভেংগে যায় সকালবেলা,বরং রিনি বেশ বেলা করে জাগে । আমি ওকে ঘুমোতে দেই,ঘুমোক বেচারী । এককাপ চা করে প্রায়ই এসে দাঁড়াই এই বারান্দায় ।
প্রথম প্রথম অনেকদূর পর্যন্ত দেখতে পেতাম ।রাস্তার উলটো দিকে একটা নারকেল গাছে ঘেরা টিনের বাড়ী । এক মধ্যবয়স্ক পুরুষ সকালবেলা তার ছেলেকে পড়াতে বসেন বারান্দায়, আমার দেখতে ভালো লাগে । এখন বাড়ীটার সামনে বহুতল এপার্টমেন্ট উঠছে,আমার দৃষ্টিসীমানা সংকুচিত হয়ে আসছে । এখনো সেই নারকেল গাছ ঘেরা টিনের বাড়ি,মধ্যবয়স্ক পুরুষের ঘর গেরস্থালী,সন্তানকে শিক্ষাদান দৃষ্টগোচর হয়, এপার্টমেন্ট পুরো হয়ে গেলে আর হয়তো দেখা হবেনা ।

মাসতিনেক আগে স্বাতী যখন ফ্লোরিডা থেকে এলো দেশে,আমাদের এই দু রুমের ফ্লাটে থেকেছিলো দুতিনদিন । রিনিই একরকম জোর করে ওকে নিয়ে এসেছিল । রিনি আর স্বাতী খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলো নিঃসন্দেহে ।
স্বাতী একটা চমৎকার দুরবীন এনেছিল আমার জন্য । আমার জন্য? না,স্বাতী আসলে আমার জন্য কিছু আনেনি ।আমি আর রিনি বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছিলাম , ও লাগেজ থেকে দুরবীনের বাক্সটা বের করে এন বলেছিল
-‘তোদের ছেলে হবে নিশ্চয়ই, ওর জন্য এটা’
আমরা খুব হেসেছিলাম । বিয়ের প্রায় পাঁচবছর,আমরা কোন সন্তান নেইনি এখনো ।

স্বাতীর দেয়া দূরবীনটা চোখে ধরলেই সেই নারিকেল গাছে ঘেরা বাড়ীটা আরো কাছে চলে আসে । মধ্যবয়স্ক লোকটা কাঠের চেয়ারে বসে,তার শিশুপুত্র বসে বেতের মোড়ায়,কোন কোন দিন দেখি ঘোমটা দেয়া এক মহিলা চা-মুড়ি এনে রাখে ওদের সামনে । শিশুটা শুকনো মুড়ি চিবোয়,লোকটা চায়ে ঢালে ।
দুরবীণ উলটো করে ধরলে আরো মজা হয়-কাছের রাস্তা,রিক্সা,এপার্টমেন্ট,মানুষজন অনেক দূরে সরে যায়,দূরে যেতে যেতে অনেক অনেক দুরে চলে যায় সবকিছু,অনেক পিছনে । অতো পেছনে গিয়ে আমি একটা চাবাগান ঘেরা টিলার উপর এসে দাঁড়াই,দাঁড়িয়ে আরো বহুদূর দেখার চেষ্টা করি ।
স্বাতী আমাকে জিজ্ঞেস করে-
কি দেখতে চাও অতোদূরে?
-আমি এখানে দাঁড়িয়ে সমুদ্র দেখতে চাই ।
-পাগল,এখানে সমুদ্র কোথায়?
-নেই হয়তো । কিন্তু আমার ইচ্ছে একটা জাহাজে চড়ে আমি গভীর সমুদ্রে যাবো , আমার হাতে একটা দূরবীন থাকবে । জাহাজের ডেকে দাঁড়িয়ে দুরবীন দিয়ে দেখবো আরো দুর দুর নীল সমুদ্র

আমার সমুদ্রযাত্রা হয়নি । স্বাতী আটলান্টিক পাড়ি দিয়ে ফ্লোরিডায় চলে গিয়েছিল ছয় বছর আগে ।
জোবায়ের গিয়েছিলো লন্ডনে,বিয়ে করে । স্বাতী আটলান্টিক পাড়ি না দিলে কিংবা জোবায়ের বিয়ে করে লন্ডন চলে না গেলে-বোধহয় আমার আর রিনির বিয়ে করা হতোনা ।
বোধ হয় কেনো? নিশ্চিতভাবেই হতোনা । এরকম কিছু হওয়ার কথা কিংবা ইংগিত ছিলোনা ।

অথচ আমি তখন উদ্ভ্রান্ত,রিনি ও ডানাভাংগা । আমাদের অপ্রাপ্তি,আমাদের দুজনের ভিন্ন ভিন্ন স্বপ্নের লাশই শেষ পর্যন্ত আমদেরকে কাছে নিয়ে এসেছিল । আমার ও তখন আর কেউ নেই, রিনি ও নিঃসংগ । দুজন পরাজিত মানুষ পরস্পরকে আঁকড়ে ধরেছিলাম ।
এখন কেবল ছুটিরদিনের সকালবেলা এইসব ভাবার অবসর পাই আমি,যখন রিনি ঘুমিয়ে থাকে । যতোক্ষন রিনি জেগে থাকে ততোক্ষন ও আমাকে সব ভুলিয়ে রাখে শরীর ও স্নেহ দিয়ে, আমি ও ওকে সব ভুলিয়ে রাখি সবকিছু মেনে নিয়ে । আমি ও রিনি ভালো থাকি,ভালোবাসি পরস্পরকে-মৃতপ্রায় মানুষ যেমন তার ক্ষয়ে যাওয়া জীবনকে । ও কখনো স্বাতীর প্রসংগ তোলেনা,আমি ও জোবায়েরকে মনে করিনা ।

স্বাতী আটলান্টিক পাড়ি দেয়ার পরের দিনগুলো আমার বিভীষিকার মতো কেটেছিলো, ওর জন্য আমার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসতো,আমার অনুভূতি আমাকে তীব্র আহত করতো । রিনি বদলে দিয়েছে সব,স্বাতীর জন্য আমার অনুভূতি ও বদলে গেছে এখন । এখন মাঝে মাঝে রিনির নগ্ন শরীরে আমি স্বাতীর মুখ বসিয়ে দিতে পারি,রিনির ভেতরে যখন প্রবেশ করি, মাঝে মাঝেই নির্দ্বিধায় চোখ বন্ধ করে শরীরের নিচে আমি স্বাতীকে আঁকড়ে ধরতে পারি । কষ্ট-টষ্ট কিছু নেই আর, আমার প্রবৃত্তি দিয়ে স্বাতীকে ছুঁয়ে ফেলতে পারি এখ্ আর গোপনে আমার বড় আনন্দ ও জাগে । আমার শরীরের নিচে শুয়ে নিরাভরন রিনি জোবায়ের পিঠেই তার নখ বসিয়ে দেয় কিনা,সে অবশ্য আমি কোনদিন জানতে চাইনি ।
স্বাতী বেড়াতে এলে আমরা খুব মজা করেছিলাম, স্বাতীর মেয়ের জন্য রিনি অনেকগুলো ড্রেস কিনেছিলো । বিশ্ববিদ্যালয়ের দিনগুলোর মতো আমরা তিনজন ঘুরে বেড়িয়েছি, আমরা জোবায়েরকে ও মিস করেছি । ও ব্যাটা এলে সেই পুরনো দিনের মতোই আবার আমরা চারজন ।
আজ রিনি ঘুম থেকে উঠলে আমরা এয়ারপোর্টে যাবো । কি এক জরুরী কাজে জোবায়ের ওর বৌ-ছেলেকে রেখে একাই আসছে লন্ডন থেকে,আমাদের ফ্লাটে উঠবে প্রথমে,তারপর ওর বাড়ি যাবে ।
আমার আর রিনির না জন্মানো ছেলের জন্য স্বাতী দুরবীন এনেছিল । আমার খুব আগ্রহ হচ্ছে আমাদের ভবিষ্যত মেয়ের জন্য জোবায়ের কি উপহার আনে?
আমাদের বিয়ের প্রায় পাঁচবছর হয়ে গেলো । ডাক্তার বলে দিয়েছে,আমাদের কোনদিন সন্তান হবেনা ।


[ লিখেছিলাম সচলায়তনে মার্চ ২০০৮]

No comments: