Tuesday, May 05, 2009

ভ্রমন আনন্দময় হয়েছিলো

.

।১।

'ভালো থাইকেন ওস্তাদ'

ওস্তাদ তার পোকায় খাওয়া দাঁত বের করে হাসলেন । জানালা দিয়ে হাত বাড়িয়ে দিলেন । আমি ও হাত বাড়ালাম ।
অর্ধেকে নেমে আসা 'অফিসার্স চয়েজ' এর বোতলটা হাতে চলে এলো । ওস্তাদের শুভেচ্ছার নিদর্শন । বোতলের অর্ধেক শেষ করেছেন ওস্তাদ, কোম্পানীগঞ্জ বাজার থেকে ভোলাগঞ্জ আসতে আসতে । আমাকে ও দয়া করেছেন অবশ্য । পাশের সীটে নজু ছিল । নামাজী ভদ্রলোক ব্যাটা । নাক কুঁচকেছে এই যা ।
ট্রাকের পেছন থেকে লাফিয়ে নামলো আবীর আর পার্থ ।
ওস্তাদ ট্রাক ঘুরালেন ।

আমাদের চার জোড়া চোখ এবার ঘুরে তাকালো আদিগন্ত । বহুদূর থেকে যা ছিলো রহস্যময় নীল, এখন তা স্পর্শের সবুজ । যেনো চাইলেই জড়িয়ে ধরা যায় । এই তো খাসীয়া পাহাড়, পাহাড়ের গায়ে তূলো তুলো মেঘ । পাহাড়ের পায়ের নীচে ছেঁড়া ছেঁড়া নদী, পিয়াইন তার নাম । শত শত মানুষ পাথর কুড়োচ্ছে । শত শত মানুষ, অথচ কি ভীষন স্তব্দতা । যেনো সবার জানা হয়ে গেছে, এই বিশালতার কাছে এসে এরকম স্তব্দ হয়ে যেতে হয় ।
এই স্তব্দতাকে মাখতেই আমরা ছুটে এসেছি শহুরে গালগল্প পেছনে ফেলে ।

ভোলাগঞ্জ পাথর কোয়ারীর কাছাকাছি কোথাও নাকি একটা সরকারী ডাকবাংলো আছে ।আবীরের বাবা'র জানাশোনা ।
একজন কেয়ারটেকার এসে আমাদের নিয়ে যাবার কথা । তার নাম শামসুদ্দিন । শামসুদ্দিন কে আমরা চিনিনা । তবে শামসুদ্দিন আমাদের চিনে নেবে ।

শামসুদ্দিন আমাদের চিনে নেয় । মধ্যবয়স্ক লোক । তেলতেলে মুখ । মুখে লাগানো হাসি ।
আমরা তার পেছনে পেছনে এগোই । পাথর দেখি । ছোট ছোট পাথর, বড় বড় পাথর । পার্থ নীচু হয়ে পিয়াইনের জলে হাত দেয় । কবি মানুষ, তাকে এই সব মানায় । আমি ঘাড় ঘুড়িয়ে মানুষ দেখি । সারি সারি 'বারকী' নৌকা ।
মানুষজন ডুব দিচ্ছে। ডুব দিয়ে তুলে আনছে বড় বড় পাথর । পেশি বহুল মানূষ গুলো । আমার সুলতানের ছবির মানুষের কথা মনে পড়ে যায় ।
আমরা এগিয়ে যাই । একটা বাঁক পেরোই । পেরোতেই অদৃশ্য হয়ে যায় পাথর কোয়ারী, 'বারকী' নৌকা আর পাথর কুড়ানো মানুষ । এখন কেবল তীব্র সবুজ । ঘন জংগল । আর কি আশ্চর্য, সেই জংগলের ভেতরই ডাকবাংলো ।

কেয়ারটেকার শামসুদ্দিন আমাদের নিয়ে আসে ভেতরে । পুরোটাই কাঠের । তিনটে বড় বড় রুম । সব গুলোই খালি । আমরা দুই রুম দখল করি । চমৎকার বিছানা পাতা । এমন কি বাথরুমে গরমপানি । পেছনে টানা বারান্দা । বারান্দায় এসে দাঁড়াতেই চোখে পড়ে দীর্ঘ বালিয়াড়ি । বালিয়াড়ির শেষে বেশকিছু কাঠের ঘর । ঘরগুলো যেনো ঝুলে আছে খাসিয়া পাহাড়ে । ওপাড়ে একটা পাকা সড়ক চোখে পড়ে । সাপের মতো পেঁচিয়ে উঠতে উঠতে হঠাৎ করেই হারিয়ে গেছে পাহাড়ের গহীনে ।

আমাদের সকলের চোখে মুগ্ধ বিষ্ময় । আর শামসুদ্দীনের ঠোঁটের কোনে গর্বিত হাসি, যেনো এই একাকী সাম্রাজ্যের সেই নৃপতি ।
শামসুদ্দীন চলে গেলে, আমরা চারজন এসে বারান্দায় দাঁড়াই । ডিসেম্বরের পাহাড়ী ঠান্ডা গায়ে লাগছে । হাল্কাপাতলা খিদে ও লেগেছে । কেয়ারটেকার নিশ্চয় খাবারের ব্যবস্থা করবে । জিজ্ঞেস করা হয়নি এখনো ।
আমি 'অফিসার্স চয়েজ' এর বোতল বের করি । গলায় ঢালি । নজু নাক কুঁচকায় । আবীর বড়লোকের ব্যাটা । সস্তা মদে আগ্রহ নেই । তবু হাত বাড়ায় । আবীরের হাত থেকে বোতল যায় পার্থ'র কাছে । কবি বলেই কিনা কে জানে, বড় নির্মোহ ভংগীমায় সে গলায় ঢালে । দ্বিতীয় চক্করেই বোতল উলটে গেলো আর আমাদের তিনজনের একসাথে মনে পড়ে গেলো- তুমুল মাতাল হবার এক ভয়াবহ পরিকল্পনা নিয়ে এসেছি আমরা এই অরণ্যে । এই এলাকায় খুব সস্তায় দেদারসে পাওয়া যায় ভারতীয় মাল । আমাদের মাতাল হবার নেশা চাগিয়ে উঠে দ্রুত ।
শামসুদ্দিন' কে ধরতে হবে ।
কিন্তু হারামজাদা গেলো কই?

।২।
শামসুদ্দীন ফিরে এলো ভুনা মাংসের ঘ্রান নিয়ে ।
রাত কতো হলো আমাদের কারোরই বোধ করি খেয়াল নেই ।ডাকবাংলোতে ডায়ানামোর আলো । বাইরে সবুজ জোছনা । জোছনা ও সবুজ হয় এমোন! খাসিয়া পাহাড়ের গায়ে থোকা থোকা আলো ।পাহাড়ীদের গ্রাম ।

শামসুদ্দীন ফিরে এলো টিফিন ক্যারিয়ার ভর্তি খাবার নিয়ে । বিনয়ের অবতার হয়ে জানালো সে বড়ো শংকিত -তার 'মুখ্যসুখ্য' বৌ এর হাতের রান্না আমাদের ভালো লাগবে কিনা?
খাবার মুখ্য নয় তখন, আমাদের পানীয় প্রয়োজন ।

তেলতেল মুখে শামসুদ্দীন হাসে
'মামারা বড়ো দিরং হয়ে গেলো । এত রাতে কই পাই? ঠিক আছে তবু একটা ঘুরান দিয়া আসি'
আমরা ও 'ঘুরান' দেবো শামসুদ্দীন । সবুজ জোছনায় মাতাল হবো আজ ।

শামসুদ্দীন হাঁটে । আমরা হাঁটি । ডিসেম্বরের পাহাড়ী ঠান্ডা গায়ে কামড় বসায় । আবীরের গায়ে লেদার জ্যাকেট । 'হারামজাদা শুয়োরের বাচচা', চৈতী কে তুই ছিনিয়ে নিবি জানি আমি । ঐ যে গায়ে জোছনা মাখছে নিঃশব্দে, পার্থ-কবি সে, কবি বলেই চৈতীকে হারাবে । আমি জানি, জানি এই সব ।

ধবধবে বালিয়াড়ীতে আমরা হাঁটতে থাকি । উথালপাতাল দিক শুন্য পূর ।শামসুদ্দীন পাওইনিয়ার । এই মাতাল রাতে তৃষ্ণার জল খুঁজে দেবে আমাদের!
একটা ঘুপচির সামনে এসে থামে সে । দেখে মনে হয়ে কোনো পাথর শ্রমিক থাকে । টিমটিমে কুপির আলো । আমি ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনে ফেলে আসা আলোকিত ডাকবাংলো দেখি । অর্থহীন ।
শামসুদ্দীন ঘুপচি থেকে বেরিয়ে আসে । মাথা নাড়ে । আমরা হতাশ হই ।কোন কথা নেই । কোনো কথা বলার নেই ।

ব্যর্থ পাইওনিয়ার ফিরতি পথ ধরে ।
আমাদের কেবল অনুসরন ।
এই তৃষ্ণার্ত রাত কতো দীর্ঘ হবে কেজানে?
ডাকবাংলোর আলো কাছে চলে এসেছে ।
শামসুদ্দীন একটুপিছিয়ে আসে । আমাদের কাছাকাছি আসে । গলা খাঁকারী দেয় । তেলতেলে হাসে ।
'মামারা, বোতল তো মিললোনা । কাইল ঐপার থাইকা এক কেইস আইনা দিমুনে । তয় এখন যদি--'
আমরা নিঃশ্বাস ফিরে পাই । ভরসা দাও কমরেড !
শামসুদ্দীন আবারো তেলতেলে হাসি ছুঁড়ে দেয়
'এখন যদি ইনজয় করতে চান, মনে লয় ম্যানেজ করতে পারুম । লাগাইবেননি?'
নজু নাক কোঁচকায় । একমাত্র সেই মাতাল নয় । বাকি তিনজন ঘাড় কাত করি ।

শামসুদ্দীন আবার হাঁটে । আমার আবার অনুসরন করি ।
একটা ভাংগা পাঁচিলের মতো । একটা ভাংগা দালানের কাঠামো ।টিমটিমে কুপির আলো । একটা শীর্ন হাত । নারী দেহের ছায়া ।
শামসুদ্দীন গলা খাঁকারী দেয় ।
ছায়া জিজ্ঞেস করে - 'কয়জন?'
আমরা নিঃশ্চুপ ।
তেলতেল মুখ বলে - 'চারজন'
ছায়ার দীর্ঘশ্বাস শুনি । ছায়া ফিস্ফিসিয়ে বলে-
'চারজনরে লাগাইতে দিলে, আগে আমার ভরপেট খাওন দেন '
তেলতেল মুখ হিসহিস করে- 'খাইয়া ল মাগী,আগে যে রান্না করলি রাখোস নাই কিছু? '
ছায়ার দীর্ঘশ্বাস আরো ধারালো শুনায়-
'না । বেবাক তো ডাকবাংলায় নিয়া গেলেন'

।৩।
রাত বোধ হয় ফুরোলো প্রায় ।
আবীর ঘুমোচ্ছে । ওর মুখে সুখী মানুষের ছায়া । ওর ঠোঁটের কোনে পাতলা হাসি । আবীর চৈতিকে ছিনিয়ে নেবে ।
বাথরুমে পানির শব্দ । নজু বোধহয় গোসল করছে কিংবা ওজু করবে । তাহাজ্জুদের ওয়াক্ত হয়ে গেছে মনে হয় ।
পার্থ বালিয়াড়ীতে চিৎ হয়ে জোছনা মাখছে । হয়তো কবিতা বুনছে। এই ছেলে চৈতীকে হারাবে ।

আমি বারান্দায় হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে ।
কারো কারো দেখে যাওয়া ছাড়া আর কোনো ভূমিকাই থাকেনা ।

[২০০৬ কিংবা ২০০৭]

1 comment:

Unknown said...

এরপর কি? এভাবে কেউ শেষ করে? :(