Tuesday, May 05, 2009

ইউটপিক

(ঋণ স্বীকার: কবি আবুল হাসান, যার নাম থেকে ঝরে পড়ে সমুহ বিষাদ)

আজকাল আর কবিতা-টবিতা পড়া হয়না একেবারেই।
আমার দশফুট বাই দশফুট রূমের দেয়াল ঘেষে একটা কাঠের শেলফ। বেশ পুরনো। ঘুন ধরে গেছে। ওর গর্ভে নির্বিবাদ পড়ে আছে কটা কবিতার বই। অযত্ন অবহেলায় । বিগত যৌবনা রমণী যেন। (যৌবন শেষ হলে কে আর রমণ করে?)

এতগুলো বইয়ের এত্তোগুলো কবিতা এখন আর বাঁধে না আমাকে। তবে এখনো একটা... না পুরো কবিতাও না, একটা লাইন, স্রেফ একটা লাইন থেকে এখনো মুক্তি পাইনি আমি ।

ছোট খাট চাকুরী করি। বলার মত কিছু না। একা মানুষ। মাসের ৩০ দিন মাথা নীচু করে হাঁটি। মাস গেলে বেতন পাই। বেতন পেলে ছুটে যাই শহরের ভেতর এক পাড়ায়। ওখানে এক রমণী তার শরীরের ভিতর আমাকে আশ্রয় দেয়, সারা মাসের অশ্লীল কষ্ট নিয়ে উপগত হই। অবশ্য এ জন্য বিনিময় মূল্য দিতে হয়।
যা হোক কথা সেটা না।

কথা হল এক লাইন কবিতা। যখন পূর্ণ বেগে ধাবমান আমি, শুরু হয়ে গেছে পিচ্ছিল যাতায়াত.. হঠাৎ মাথার ভিতর বেজে উঠে ঐ লাইন। যেন মৃত্যু ঘোষণা। প্রবল আক্রোশে ফেটে পড়ি। কবিতার শরীর খুঁজি। না পেয়ে আঁকড়ে ধরি নারীর শরীর। পাশবিকতায় নারী তৃপ্ত হয়। যে কোন নারী। সেও। বিশ্রী ভাবে শ্বাস নেয়, প্রশ্বাস ফেলে। স্বভাবজাত কপটতায় বলে উঠে ’তুমি একটা পশু, এত জোরে কেউ...!’
পশুরও পাপ বোধ জেগে উঠে রমণ শেষে। পাপ দিয়ে পাপ মোছন করতে হয়। এক বোতল সস্তা হুইস্কি নিয়ে ঘরে ফিরি। আমার একলা ঘরে। তরল আগুন ঢালি গলায়... হাওয়া হাওয়া সুখ। উড়ে যাবার প্রস্তুতি নেই। এমন সময় আবার আঘাত হানে ঘাতক শব্দমালা :
’ আমাদের অন্তর্গত রক্তে খেলা করে বিপন্ন বিস্ময়’

এক লাইন জীবনানন্দ এভাবে আমাকে নিয়ে কেবলই খেলা করে। একদিন আমিও খেলনা থেকে হয়ে উঠি খেলোয়াড়। প্রত্যেকটা শব্দ ভাঙি, গড়ি, বিন্যাস করি। হঠাৎ করেই হয়ে যাই আর্কিমিডিস। ইউরেকা! পেয়ে যাই মর্মার্থ। বিপন্ন বিস্ময়-- এ বিস্ময় তো বস্তুত সেই সর্বনাশ! রক্তের ভিতরের সুন্দর সর্বনাশ! শ্রম দাসের বিক্ষত পিঠের মতো চিরন্তন । পৃথিবী যতবার খুশী ঘুরে আসুক সূর্যের চারপাশ, উজাড় হয়ে যাক আমাজানের গহীন জঙ্গল,আবিস্কার হোক দারিদ্র্য বিমোচনের অব্যথ দাওয়াই। ঘোষিত হোক ফরমান ’স্যানেটারী ন্যাপকিন ছাড়া আর কোথাও রক্তপাত হবে না’ ...যত কিছু হোক যত যা কিছু, মানুষের রক্তে তবু থেকে যাবে এ সর্বনাশ।

যেমন রয়ে গেছে তুমি, তোমার স্মৃতি ।
যখন আমি লুকোচুরি খেলছি পসরা রমণীর সাথে, বুঝতে দিচ্ছি না কি সুখ আমি লুট করে নিচ্ছি তার শরীর থেকে, তখন হঠাৎ তুমি এসে দাঁড়াও ঐ কবিতার মত। এক বিরাট ছন্দপতন। আঙুলের নখগুলো বড় হচ্ছে,তুমি এসে দাঁড়াও। মনে পড়ে যায় কেমন যত্ন করে তুমি আমার নখ কেটে দিতে। ছুটির দিনে একলা ঘরে বন্দী হয়ে থাকি। মনে পড়ে এরকম একা ঘরে তুমি একদিন আমার জন্য রেঁধেছিলে ।

আসলে মানুষ বড় দুর্ভাগা জীব। কুকুরের তবু ভাদ্রমাস আছে। পরের ভাদ্রে পুরনো সঙ্গীকে মনে রাখার কোন দায় থাকেনা তার। হায় মানুষের তেমন কোন ভাদ্র মাস নেই। ঐ সর্বনাশ বারমাসই তাকে মনে করিয়ে দেয় সব কিছু। বার বার।


মাঝে মাঝে তোমারও কি মনে পড়ে না? বেরুতে বেরোবে। সাথে তোমার স্বামী। বারান্দায় দাঁড়ানো নতুন মডেলের গাড়ী। সামনে কত আনন্দ, পার্টি, পাঁচতারা হোটেল। গাড়ীর আয়নায় চোখ পড়তেই কি সব এলোমেলো হয়ে যায় না? মনে পড়েনা এরকম নীল শাড়ী পড়লেই একজন বিমূর্ত বিস্ময়ে তোমাকে দেখত - ? আহ্ সেই একজন!

আসলে প্রত্যেক মানুষেরই নিজস্ব কিছু জটিলতা থাকে। এই আমি কখনো মাকে তেমন ভালবাসতে পারিনি যেমন বাসে সবাই, বাবাকে আমার ঘৃণা করার কথা ছিল কিন্তু কেন যে শেষ পর্যন্ত করুনা করতে শুরু করলাম? আর কেনই যে মানুষ পরস্পরের কাছে উন্মুক্ত করে তাদের পাঁজরের দ্বার। আমরাও কেউ ভিন্ন নই।
কেমন নিস্পাপ সরলতায় এসে বলতে-- ’রাতে ঘুম হয়নি’। বোকা বোকা গর্ববোধ হত -’বোধ করি আমাকে ভেবে ভেবেই!’
পরে একসময় ফ্রয়েড পরে বোঝেছি তোমার তখনই পুরুষের প্রয়োজন ছিল,যেমন তেমন একখানা জ্যন্ত পুরুষ। আমি না হয়ে অন্য কেউ হলেও চলত। যেমন চলছে এখন। ’লিখতে এবং করতে আমার কোন ক্লান্তি নেই’। বলেছিল কবি আবুল হাসান। বেচারা! কোথায় এখন সুরাইয়া খানম।

এ সত্যটা এখন ভালই বুঝি কেউই যে অপরিহার্য নয় কারো জন্য। তবু রক্তের ঐ বিপন্নতা উলট পালট করে দেয় সবকিছু। সুখতাড়ানিয়া স্মৃতি, বোতল ভরা দহন আর জীবনানন্দ কবি- তিনজন মিলে হাজির করে ইন্সোমনিয়া, হ্যালুসিনেশন, ইউটোপিয়া...

এ জলা জংলার দেশ, মশা আর লোডশেডিংয়ের ডাস্টবিনটা হয়ে গেছে নন্দন কানন। চারদিকে সব উজ্জ্বল উচ্ছ্বল মানুষ। মঙ্গল গ্রহের রকেট ধরতে ছুটছে এক রঙ্গীন কিশোরী। পার্কে ছবি আঁকছেন পিকাসো, হোটেলে কবিতা পড়ছেন বোদলেয়ার আর রাজনীতি নিয়ে কথা বলছেন স্বয়ং সক্রেটিস। প্রতিটি দিনেই রয়েছে উজ্বল আলো আর মাতাল বাতাস এবং প্রত্যেক শহরের পাশেই একটা করে নিজস্ব সমুদ্র। এরকম একটা সমুদ্রের তীরেই আমি তোমাকে আবিস্কার করলাম আবার। তোমার পাশে অন্য কোন পুরুষ নেই। পরনে সেই নীল শাড়ী। কতদিন পর দেখা! কত বয়স হল তোমার? ষাট/সত্তুর/শত/হাজার বছর...? সময়ের নির্মমতা তবু স্পর্শ করেনি। তবু এক দ্রোপদ মনীষা নিজস্ব ভূগোলে। যেন সব প্রশ্নের উত্তর ওইখানে। তোমাকে স্পর্শ করিনা। কখনেই করিনি। বেলা ভূমিতে নতজানু হয়ে বসি।
শুধু বলি--’ তুমি ভালবাসা মানে বুঝো মেয়ে?/কোন গাণিতিক জটিলতায় তোমাকে বিক্রী হয়ে যেতে হয়?/ আর কেনই বা এই সব অবহেলা, দুঃস্বপ্ন ফিরে আসে বার বার? ’

তুমি কোন কথা বলো না। কেবল নিঃশব্দে হাসো। যেন ছেলেমানুষ আমি। অসহ্য লাগে, কে যেন আমাকে বলে দেয়
আসলে তুমিই আমার অন্তর্গত রক্তের সেই বিপন্ন বিস্ময়।

তোমার বিমূর্ত হাসি একটা দেয়াল গড়ে তুলছে। তোমাকে আড়াল করে ফেলছে ঐ দেয়াল। না আমি আর হারাতে চাই না। হাতের কাছে যা পাই ছুঁড়ে মারি ঐ দেয়ালে-অসহায় আমি।

কাঁচভাঙা আর্তনাদ গুমরে ফেরে আমার দশফুট বাই দশফুটে।
এই ভাবে প্রতিমাসে একবার রুটিনমত আমার নিজস্ব গুহায় সহবাস করি আমি, আমার স্মৃতি,স্বপ্ন, কষ্ট, ব্যর্থতা আর ভাঙা কাঁচের বোতল।


[ '৯৬ এ লেখা । আমাদে কাগজ 'সহবাস' এর প্রথম সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছিল ]

No comments: