Tuesday, May 05, 2009

নিঃশ্বাস, নীল অরণ্যে

‘ডেভলপমেন্ট ইকোনমিকস' -এর ক্লাসে ঘুম পাচ্ছিল হাসানের।

অর্থনৈতিক উন্নয়নের ইতিহাস যে দিকেই গড়াক, নিজের আর পরিবারের আর্থিক সামর্থ ক্রমশ: তলানীতে এসে ঠেকছে- হঠাৎ মনে পড়তেই খুব শীত শীত করছিল হাসানের। ইচ্ছে করছিল সামনের ডেস্কের একেবারে কোণায় বসা প্রতীতির কাঁধে মাথা রেখে একটা লম্বা শ্বাস নেয়ার।

মায়ের অসুখটা ক্রমশ: বাড়ছে। জলের মত টাকা খরচ হচ্ছে। অনার্সের পর এম.বি.এ করার জন্য জমিয়ে রাখা বাবার পেনশনের টাকা এবার যাচ্ছে। তবু হচ্ছে না। হাসানের নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হয়। আর নিঃশাসের সমস্যা হলেই প্রতীতির কাঁধে মাথা রেখে একটা লম্বা শ্বাস নেয়ার ইচ্ছেটা ও তীব্রতর হয়। আর সে মেয়েও হাসানের ইচ্ছে’র ঘ্রান পায়।
চোখের পাতা একটুও না কাঁপিয়ে যে ছেলে চোখে চোখ রাখতে পারে, একবার- কেবল একবার সে নাম ধরে ডেকে উঠতেই তো প্রতীতি হয়ে উঠতো তার অরণ্যের সবুজ।

কিন্তু কিছু কিছু পুরুষ সবুজ চেনেনা। বরং তারা অরণ্যের নীলে খোঁজে নিশ্চিত অবগাহন। কেননা সবুজকে তো আর সবাই ই সবুজ ডাকে!

ক্লাশের পর চার চাকার মোটযান ক্রমশ: দূর মিলায়-প্রতীতিকে নিয়ে।
পিছনে প্রযুক্তির বিষ- কালো ধোঁয়া।
নীল অরণ্যের পোষ্টম্যান হাসান-নিঃশ্বাসে আবারো কষ্ট ।

।।২।।
সূর্য জ্বলছে ।

বাড়ী ফিরতেই মৃদু গোঙানী। মায়ের। একরাশ নিঃশ্বাস অকারণে হারিয়ে যায়। ওঘর থেকে যন্ত্রণা ভেসে আসে।
কাঁধের ব্যাগটা রাখে। টেবিলের উপর-প্রোডাকশন ম্যানেজমেন্ট, জীবনানন্দ। আবুল হাসান। যে কোন একটা পাতা খোলে আঙ্গুল
‘হলুদ সন্ধায় একা একা, আমি হায় কার অভিশাপে
এত নির্জনতা , বিমর্ষ স্তব্দতা এই আমার রক্তের, করছি কেবল পান’

বিছানার পাশে বাবা, বড় আপা, একজন বিব্রত ডাক্তার।
জ্ঞান নেই। চোখ বন্ধ। প্রচন্ড কষ্টে উঠানামা করছে বুকের হাপর।

হাসানের কেমন অদ্ভুত লাগে সব কিছু। পৃথিবীর এত আলো-তবু দৃষ্টি দিতে পারছেনা একজনকে। এত ভারী বায়ুস্তর । তবু নিঃস্বাস দিতে পারছেনা একজনকে। হুড়মোড় করে বাঁধ ভাঙে। প্রবল শোকার্ত বৃন্ডিপাত। হাসান থামতে দেয়না। যাক ভেসে যাক, ভেসে যাক সব। সে জানে জননীর এই তার শেষকৃত্য । এরপর যা হবে- সকলই আনুষ্ঠা নিকতা।

সন্ধ্যার পর সবাই গোরস্থান থেকে ফিরে। হালকা পাতলা শীত। মাথার ভেতর টলমল ক্লান্তি।

কাউকে ট্রেনে তুলে দিয়ে এল নাকি হাসান?
গভীর রাতের কোন ট্রেন?
মাঝরাতে ময়লা চাঁদ লোহার ব্রীজ পেরোয়। ট্রেন আর বিশাল জল। মধ্যে থেকে জেগে উঠে পৌরাণিক মিথের মত কোমল শৈশব। যেন পরিত্রাণ আছে আজো, আছে ফিরে যাওয়া। হায়! যন্ত্রনার তীব্রতা জুড়ে ভাঙা কাঁচের আড়শী।

প্রিয় প্রতীতি, মৃত জননী অথবা চুরি হয়ে যাওয়া নিঃশ্বাস- কে যেন ডাকনাম ধরে খুব ডাকতে থাকে হাসানকে।
তবু তার ফেরা হয়না।

[ বোধ করি ২০০১ এ লেখা ]

No comments: