Tuesday, May 05, 2009

।। কবি ও প্রেমিকাগন ।।



আমার এমন হয় ।
দীর্ঘ প্রস্তুতির বিনিময়ে কোন কোন কাজ শেষ করতে গিয়ে, শেষ মুহুর্তে আমাকে আঁকড়ে ধরে অবসন্নতা । মনে হয়, থাক । বরং বাদ দেই, বরং ফিরে যাই…
প্রথম যেদিন রিমি’র জামার বোতাম খুলেছিলাম-আমার দীর্ঘ প্রস্তুতি ছিল সেটা,মনে আছে । কারো কারো এইসব সহজে হয়ে যায় । আমার হয়না । বেশ তো ক’দিন হয়ে গেল । এখনো মনে আছে, রিমি’র জামায় পাঁচটা বোতাম ছিলো । ও চোখ বুঁজে ছিলো । আমি প্রথম বোতামে বেপরোয়া ছিলাম,দ্বিতীয় বোতামে কামার্ত, তৃতীয় বোতামে সাহসী হয়ে চতুর্থ বোতামে অবসন্নতা ।মন বলছিল- থাক এতোটুকুই, বাদ দেই এবার, ফিরে যাই । মুহুর্তের অমনোযোগীতায় রিমি চোখ খুলেছিল আর হাতের আঙ্গুল ও অবাধ্য হয়েছিল আমার ।
এই বিকেলে কালো গেটের সামনে দাঁড়িয়ে সেই একই রকম ফিরে যাওয়ার আকুতি টের পাই নিজের ভেতর অথচ এই বিকেলের জন্য, এই গেটের সামনে দাঁড়ানোর জন্য কতোদিনের অপেক্ষা আমার!
এবারো হাতের আঙ্গুল অবাধ্য হয়ে উদ্ধার করে আমাকে । কলিং বেল চাপি ।
মধ্যবয়স্ক কাজের লোক এসে গেট খুলে দেয় ।
আমার কি কিছুটা মন খারাপ হয়?

লোকটা নাম জিজ্ঞেস করে,তারপর জানান দেয়-তিনি ভেতর ঘরে অপেক্ষায় আছেন । আমি লোকটাকে অনুসরন করি কেবল । অনুসরন করতে করতে ঘাড় ঘুরিয়ে বাড়ীটা দেখি । খুব পুরনো নয় অথবা বাড়ীটা পুরনোই,নতুন করে সাজানো হয়েছে । দোতলায় টানা ছাদ, নিচে বেশ বড় একটা বাগান, বাগান পেরিয়ে মুল বারান্দা । আমরা বারান্দায় উঠি । বারান্দা পেরিয়ে ভেতর ঘর ।
ভেতর ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে তিনি। বয়স হয়েছে বুঝা যায় কিন্তু চিবুকে এখনো স্নিগ্ধতা ও আভিজাত্যের মিশেল । বেশ ঘরোয়া কিন্তু দামী শাড়ী জড়ানো গায়ে । কোন কোন মুখ দেখলে সাদা-কালো এলবামের ধ্রুপদী ছবি মনে হয় । এ মুখ সেরকম ।
তাঁর চোখে কৌতুহল,ঠোঁটে চাপা হাসি ।
-টেলিফোনে গলা শুনে আপনাকে আরো বয়স্ক মনে হচ্ছিলো ।
আমি হাসি । সবিনয়ে বলি-
-আমাকে তুমি করে বললে খুশী হবো ।
-ঠিকাছে, ভিতরে এসো ।

আমরা ভেতরে যাই।কাজের লোকটা অন্য কোথাও চলে গেছে।এই ঘরে শুধু তিনি এবং আমি। বেতের সোফায় বসি।পাশের সোফায় বসতে বসতে তিনিই কথা শুরু করেন-
-আমি কিন্তু তোমাকে ঠিক চিনতে পারিনি ।

নাম শুনে চিনে ফেলা অসম্ভব জেনেই আমি আমার নামটা বলি । তারপর বলি
-আমি ঢাকা থেকে এসেছি । সিনেমা বানাই
-ওহ । শুটিং করতে এসেছো? আমাদের ছোটবেলায় এখানে কতো শুটিং হতো । এখন মনে হয় সেরকম হয়না ।
-আমি ঠিক ওরকম সিনেমা বানাইনা । ডকুমেন্টারী করি ।
-আচ্ছা!

টের পাই-আমার সামনে যিনি বসে আছেন-এই শহরের সরকারী বালিকা বিদ্যালয়ের অবসর নেয়া প্রধান শিক্ষিকা,যার স্বামী বছর কয়েক আগে প্রয়াত, ছেলে মেয়েরা লন্ডন ও নিউইয়র্কে সেটেলড, নিজে ও বছরের বেশীর ভাগ সময় এখন বাইরে থাকেন- তার ভেতর আমাকে নিয়ে যুগপৎ কৌতুহল ও অস্বস্তি কাজ করছে ।
আমাদের মধ্যে ছেঁড়া ছেঁড়া কথা হয়
-আমি গত সপ্তাহে লন্ডন থেকে ফিরেছি । এতো ঠান্ডা পড়েছে এবার । ভাল্লাগেনা থাকতে ।
-আমি জানি ।
-জানো?
-জ্বি । আপনার ফেরার অপেক্ষায় ছিলাম । ফিরেছেন জেনেই আমি এসেছি ।

এবার তিনি স্পষ্ট করে আমার দিকে তাকান । কন্ঠ একটু ও না কাঁপিয়ে বলেন
-ঠিক কি কাজে তুমি এসেছো, বলোতো?

আমি বুকের একটু গভীরে বাতাস টেনে নেই । ধীরে ধীরে নিঃশ্বাস নিতে নিতে বলি
-একটা ডকু ফিল্ম বানাতে যাচ্ছি । আপনার সাহায্য দরকার । ইনফ্যাক্ট আপনার সাহায্য ছাড়া আমি পারবোনা । সেজন্য আপনার লন্ডন থেকে ফেরার অপেক্ষায় ছিলাম ।

তিনি হেসে উঠেন
-তোমার ফিল্ম বানাতে আমি সাহায্য করবো? কি সাহায্য করবো বলোতো? নানী-দাদীর ক্যারেক্টার করতে হবে? আমি জীবনে ও অভিনয় করিনি ।
তার হাসিতে আমি ও হাসি
-৩০ বছর আগে জন্ম নিলে আপনাকে আমার ফিল্মের নায়িকা বানাতাম
এবার আমরা দুজনেই একসাথে হেসে উঠি ।

হাসির রেশ থামার আগেই আমি জরুরী কথাটা বলে ফেলি
-একসময়ের বিখ্যাত একজন কবি’কে নিয়ে আমি ফিল্ম করতে চাচ্ছি । তার জীবনের জরুরী কিছু বিষয় আপনার সাথে জড়িত । এ গুলো আমার জানা দরকার ।
খুব স্থির কন্ঠে তিনি বলেন
-কার কথা বলছো তুমি?
-কবি রায়হান মুস্তাফিজ ।
-তুমি কে?
-আমি তার ছেলে ।

তিনি আর্তনাদের মতো আমার অগ্রজের ডাক নাম উচ্চারন করেন ।
-ও আমার বড় । খুব ছোটবেলায় আপনি ওকে দেখেছেন । আমার জন্ম তার পরে । আমরা তখন এ শহর ছেড়ে চলে গেছি ।


কাজের লোক ট্রলি ভর্তি নাস্তা নিয়ে ঢুকে । আমাদের কথায় স্তব্দতা নেমে আসে । তিনি আমাকে গাজরের হালুয়া এগিয়ে দেন । আমি নাড়াচাড়া করতে থাকি ।
কাজের লোক বেরিয়ে গেলে তিনিই আবার কথা শুরু করেন
-তোমার বাবা আমার কথা বলেছে?
-না । মা ।
- ও । কেমন আছেন তিনি?
-মা মারা গেছেন চার বছর আগে ।
- আমি দুঃখিত ।
-না ঠিকাছে । মারা যাওয়ার আগের দুবছর মা বিছানায় পড়েছিলেন । বড় ভাই কানাডায় চলে গেছে । বাবা ও তার মতো সময় কাটাতো । একমাত্র আমি মায়ের পাশে বসে থাকতাম । সেই সময়ে প্রথম আপনার কথা শুনি । মা অনেক গল্প করতো আপনার ।
-তোমার মা খুব ভালো ছিলেন ।
-আপনার তো বান্ধবী ছিলেন ।
-এক সাথে পড়েছি ।

কথা আবার থমকে যায় । তিনি বাবার কথা জিজ্ঞেস করেননা । তার জানতে ইচ্ছে করেনা নাকি অস্বস্তি?
-মায়ের মৃত্যুর পর বাবা ও চলে গেছে বড়ভাই এর কাছে । কিডনীর সমস্যায় ভুগছে ।
-ও
-বাবার সাথে আমার কখনোই তেমন ঘনিষ্ঠতা হয়নি । মা বিছানায় শুয়ে শুয়ে এতো গল্প করতো মানুষটাকে নিয়ে, পরে মনে হলো তাকে নিয়ে একটা ফিল্ম করা যায় ।
-তোমার মায়ের কাছে আর কি শুনেছো?
-বাবা এবং আপনার দীর্ঘসম্পর্ক ছিলো । আপনি চমৎকার গান গাইতেন আর কবি হিসেবে বাবার খ্যাতি ও ছড়াতে শুরু করেছে, সাথে ভালো চাকরী । প্রথম দিকে কিছুটা আপত্তি থাকলে ও শেষপর্যন্ত দু পরিবারের সম্মতি ছিলো । ছোট্ট মফস্বল শহরে আপনারা ছিলেন আদর্শ জুটি । কিন্তু…
-শেষ পর্যন্ত আমাদের বিয়ে হয়নি ।
-ঠিক এই বিষয়টাই আমি জানতে চাইছিলাম ।
-কেনো তোমার মা তোমাকে বলে যাননি?

আভিজাত্য ও স্নিগ্ধতা জড়ানো কন্ঠে তার এই প্রথম আমি কিছুটা শ্লেষের ইংগিত পাই ।
-না । এটা মায়ের কাছে ও রহস্য ছিলো ।
-তিনি তোমার বাবার বিবাহিত স্ত্রী ছিলেন ।
-মা আপনার বান্ধবী ছিলেন
-আমরা একসাথে পড়েছি ।
-যাইহোক । আপনি তো জানতেন তাকে । অতোটা সপ্রতিভ কখনোই ছিলেন না । নিজের ভেতর গুটিয়ে থাকতেন । বাবার সাথে ও তাকে আমরা খুব বেশী কথাবার্তা বলতে দেখিনি ।
-কিন্তু তোমার বাবা তো তাকেই বিয়ে করেছিলেন
-হ্যাঁ । আমার মায়ের কাছে ও এটা শেষদিন পর্যন্ত রহস্য ছিলো বাবা কেনো শেষপর্যন্ত তাকে বিয়ে করেছিলেন ।
-তাই নাকি? ভালো ।

আমি টের পাই একটা জটিলতা স্পর্শ করছে তাকে । আমি যা জানতে চাইছি তার বদলে কথাবার্তা চলে যাচ্ছে একজন প্রয়াত ও দুজন প্রায় বৃদ্ধ মানুষের বিগত যৌবনের হিসেব-নিকেশে । এখানে দাঁড়িয়ে আমি কার প্রতিনিধিত্ব করছি ? আমার মৃত নিস্প্রভ মায়ের,মৃত্যুর মুহুর্ত পর্যন্ত গুনী স্বামীর প্রতি যার অগাধ মুগ্ধতা ছিলো নাকি আমার সংস্পর্শহীন বাবার যাকে আমাদের কোনদিন তেমন করে বুঝে উঠা হয়নি ?
কিন্তু আমি তো এসব থেকে নিজেকে আলাদা রেখে প্রফেশনালী কিছু তথ্য জানতে চাই শুধু ।

আমি সমস্ত অস্বস্তি ঝেড়ে ফেলে এবার সরাসরি তাকে জিজ্ঞেস করি
-কবি রায়হান মুস্তাফিজের সাথে শেষপর্যন্ত আপনার বিয়েটা হলোনা কেনো? আমার ফিল্মের জন্য এই তথ্যটা জরুরী । প্লিজ আপনি ইজিলি আমাকে বলেন, সমস্ত প্রস্তুতি শেষে ও কেনো রায়হান মুস্তাফিজ বিয়েটা ভেংগে দিলেন ?

ঢং করে আওয়াজ দিয়ে না উঠলে আমি খেয়ালই করতাম না ঘরের দেয়ালে একটা বিশাল ঘড়ি । তার পেন্ডুলাম দুলছে ।
ঠোঁট কামড়ে তিনি উঠে দাঁড়ালেন । তার মুখের রঙ এতোটা সাদা আগে খেয়াল করিনি ।
-আছরের ওয়াক্ত হয়েছে, আমি নামাজ পড়তে যাচ্ছি । তুমি নাস্তাটা শেষ করে যেও ।



তিনি তার সমস্ত আভিজাত্য ও স্নিগ্ধতা নিয়ে চলে গেলে আমি স্থির দাঁড়িয়ে থাকি । পুরনো দিনের বিশাল দেয়াল ঘড়ির কাটাগুলো টিক টিক করে । বছর পঁয়ত্রিশ আগের সদ্য তরুনীকে আমার দেখতে ইচ্ছে জাগে । মফস্বল শহরের তার সৌন্দর্য্য রুপকথার মতো ছড়িয়ে বেড়াতো । মৃত্যুশয্যায় শুয়ে শুয়ে ও আমার মা সেই গল্প বলতেন । তার বলায় কোন হিংসা ছিলোনা । স্বামীর সাবেক প্রেমিকার জন্য তার নিজের ও মুগ্ধতা ছিলো । নাকি এই প্রসিদ্ধ সৌন্দর্য্যকে অস্বীকার করে বাবা তাকেই বিয়ে করেছিলেন বলে আমার অপ্রতিভ, গুরুত্বহীন মায়ের গোপন অহংকার ছিলো?

বাবা লোকটা চিরদিন আমার কাছে বিরক্তিকর এক রহস্য থেকে গেলো । আমি তার মতো এতোটা নির্মোহ, নিমগ্ন অথচ অন্যদের কাছে গুরুত্বপূর্ন হয়ে উঠতে পারলাম না । মায়ের প্রতি তার কোন মনোযোগ ছিলোনা তবু মায়ের কি অসীম মুগ্ধতা ছিলো এই মানুষটার জন্য। দীর্ঘ সম্পর্কের পরিনতিতে বিয়ের সমস্ত আয়োজন শেষে যে প্রেমিক অস্বীকৃতি জানায় তার জন্য ও এই ধ্রুপদী সুন্দরীর এতো অভিমান?
লোকটাকে আমার অসহ্য ঠেকে ।

-তোমার বাবার বিরহের শখ জেগেছিলো । তার কবিত্বের পূর্নতার জন্য নাকি ওটা জরুরী ছিলো
আমি ঘাড় ঘুরিয়ে তাকে দেখি । তিনি ভেতরের সিঁড়ি ভেংগে নেমে এসেছেন আবার । এবার তাকে অনেকটা স্থির দেখাচ্ছে,যদি ও চোখ দুটো লাল হয়ে আছে ।
-জ্বি!
-হ্যাঁ, তুমি তো এটাই জানতে চেয়েছিলে । বড় কবি হওয়ার লোভে তোমার বাবা আমাকে বিয়ে করেননি । তিনি বড় কবি হয়েছেন ।
-ও
আমি কোন ভাষা খুঁজে পাইনা ।
-আমাদের যেদিন আনুষ্ঠানিক ভাবে বিয়ের দিনতারিখ ঠিক হবার কথা সেদিনই তিনি আমাকে জানিয়েছিলেন, কবি হওয়ার জন্য তার বিরহের অভিজ্ঞতা খুব জরুরী । যেনো আমি তাকে সেই অভিজ্ঞতা দান করি । তোমাকে বাবাকে আমি বড় কবি হবার জন্য বিরহ দান করেছিলাম

আমার কাছে সবকিছু পাজলের মতো লাগে । তার দিকে আমি চোখ তুলে তাকাতে পারিনা । যেনো রোমান সম্রাজ্ঞীর দারুন গরিমা নিয়ে তিনি এক কবিযশপ্রার্থী অপরিপক্ক তরুনকে মৃত্যুদন্ড দান করছেন ।
এই গরিমা, তার কন্ঠের তেজ আমার কাছে অসহ্য লাগে ।
-তোমার সিনেমাটা বানানো হলে আমাকে জানিও । বহুদিন সিনেমা দেখিনি । কি নাম দেবে সিনেমার?

বাহ। মুহুর্তের মধ্যে আমি আমার না বানানো সিনেমার নাম খুঁজে পাই । এই নামই হবে গরিমাময়ী সম্রাজ্ঞীর বিরুদ্ধে আমার সামান্য অস্ত্র ।
- সিনেমার নাম হবে ‘কবি ও প্রেমিকা গন’
-প্রেমিকা গন ! ‘গন’ কেনো?

আমার অস্ত্র তবে একেবারে ভোঁতা নয় । তারদিকে আর না তাকিয়ে বাইরে দরজার দিকে পা বাড়িয়ে বলি
-কারন কেবল আপনিই কবি রায়হান মুস্তাফিজ এর একমাত্র প্রেমিকা ছিলেন না ।

আমি তার দিকে তাকাইনা আর ।
কিন্তু তার নিচু কন্ঠের স্পষ্ট উচ্চারন শুনি
-তুমি তোমার বাবার মতোই হয়েছো ।

সম্রাজ্ঞীর আহত কন্ঠ কেমন গোঙ্গানীর মতো শোনায় । বেদনাহত । আমি চোখ নিচু করি ।
কোন কোন দূরত্ব এতো অনতিক্রম্য হয়ে উঠে কেনো?


[ লিখেছিলাম সচলায়তনে মার্চ ২০০৯]

2 comments:

হাসান রায়হান said...

পড়লাম বস । অল্প কথায় ছোট ছোট গল্প পড়তে ভালোই লাগে। তবে গল্প আরেকটু বড় হলে কাহিনীটা জম্পেশ হয়ে উঠে।

হাসান মোরশেদ said...

ধন্যবাদ বড়ভাই । খুঁজে সময় করে পড়েছেন বলে ।
প্রোফাইল ছবি কি সাম্প্রতিক? একবছরে স্বাস্থ্যের উন্নতি হয়েছে, মনে হচ্ছে :)